সময়ের কলম ভূত

জাইদুল ইসলাম দুর্লভ | বুধবার , ৯ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

গণিত ও ইংরেজিকে ভয় পায় না তেমন ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা খুবই কম । দুটো বিষয় রীতিমতো আতংক। সে আতংক আর ভয়ে কত ছেলেমেয়ে যে স্কুল ছেড়ে গেছে। কত ছেলেমেয়ে বদদোয়া করতো অংক স্যারের যেন একটু অসুখ হয়। ইংলিশের রূপনা মেম এর কেন বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না সে চিন্তায় থাকতো পেছন বেঞ্চের তমাল,শফিরা। সেই গণিত ও ইংরেজিতে বারবার হায়েস্ট মার্ক পাওয়া শ্রেয়মের রোল কোনভাবেই দশের ভিতরে আসেনা!

গ্রামীণফোনের উচ্চপদের কর্মকর্তা শান্ত নরম সেই পাপ্পাই সোজা বলে দিয়েছে, এবার রোল দশের ভিতর না এলে তাকে শহরের দশতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে গ্রামীণফোনের টাওয়ার বানিয়ে দিবে! সেটা শোনার পর শ্রেয়মের শরীর রোদের গরমে এখনি পুড়ে যাচ্ছে।

সে কি করবে, বাংলা পড়া তার মুখস্থ থাকেনা। লিখতে গেলে কেমন সব গুলিয়ে যায়, তাড়াতাড়ি লিখতে পারেনা দেখে বাংলায় কখনো ফুলমার্কস আনসার করতে পারে না। বাংলা লেখা তার নাকি চায়নিজ চায়নিজ মনে হয়। লিখতে গেলে একেকটা কাকের ঠ্যাং,বগার ঠ্যাং হয়ে যায়। এই বাংলার জন্যই রোল কোনভাবেই দশের ভিতর আসছেনা তার।
রাত অনেক হয়েছে।
শ্রেয়মের কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই ঘুম আসছেনা তার। কেবল দশতলা বিল্ডিংয়ের উপর টাওয়ার দেখে সে। সত্যি সত্যি কি পাপ্পা তাকে টাওয়ার বানিয়ে বসিয়ে দিবে! পাশের বিল্ডিংএ একটা টাওয়ার আছে, নইলে পাপ্পাকে বুঝিয়ে বলতো সেখানে বসাতে। তাহলে সময়ে সময়ে সে ভাত নাস্তা অন্তত পানির তৃষ্ণা লাগলে আম্মুকে চিৎকার করে বলতে পারতো। তিতলি, পার্থিব, তীর্থ কেউনা কেউ নাস্তা পানি নিতো। কিন্তু…।
কিন্তু পাপ্পা বলেছে দশতলা বিল্ডিংয়ে বসাবে। দুপুর হতে বিকেল শেষ করেছে আশেপাশে কাছে কোথায় দশতলা বিল্ডিংয়ের দেখতে পায়নি।

– শ্রেয়ম ঘুমাচ্ছিস না কেন?
– ঘুম আসছেনা আম্মু।
– এতো নড়াচড়া করলে ঘুম আসবে কি করে!
শ্রেয়ম মিনমিন করে বলে, আম্মু তুমি শুধু নড়াচড়াই দেখছ। আমার ভেতরে যে জেনারেটর চলছে।। তোমার ত ঘুম আসবেই আম্মু। তুমি এসিতেই থাকবা,আমাকেই না রোদে পুড়তে হবে,বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। গলা শুকালে একগ্লাস ফ্রিজের পানিও পাবো না!!
– কিরে প্যান প্যান করে কি বলছিস?

– আচ্ছা আম্মু পাপ্পা কি আমাকে সত্যি সত্যি দশতলার ছাদে টাওয়ার বানিয়ে বসিয়ে দেবে?
– না, না দশতলায় না। আমি বুঝিয়ে বলবো যেন ছয় সাত তলায় বানায়।
– আম্মু ছয় সাত তলাও তো অনেক উঁচু, সূর্য খুব কাছাকাছি হবে।
– তার নিচে বসলে ফোনে নেটওয়ার্ক পাবে নাতো বাবা।
– তার মানে আমাকে টাওয়ার বানাবেই…!!
– আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়, সকালে স্কুল আছে।

– সকালে তোমাকে নিচতলা হতে বাজার এনে দিলাম, গাছে পানি দিলাম, বিকেলে ছাদ হতে কাপড় আনলাম, তবু্‌ও আমার জন্য মাত্র দুই তিন তলা কমালে! হয়েছে আমাকে ছয় সাততলাতে নামাতে হবে না, দশ তলাতেই টাওয়ার বানাতে বলিও।
বিড়বিড় করে চোখ বন্ধ করলো শ্রেয়ম।

২.
আজ শ্রেয়মের জন্মদিন।
ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র হাতেগোনা আঠারো দিন বাকি। জন্মদিন টন্মদিন কিছুই ভালো লাগছে না তার। গত একমাস সে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি টাওয়ারের ভাবনায়। পাপ্পার সিলেটের অফিসে মিটিং আছে তাই আসতে পারছেনা। ফুডপান্ডাতে পঁচিশ জনের খাবারের অর্ডার করে দিয়েছে। সন্ধ্যার আগেই সময় শব্দ অথৈরা হাজির। শ্রেয়মকে একপাশে টেনে নিয়ে সময় একটা গিফট বক্স হাতে তুলে দিয়ে বলে, এটা কারো সামনে খোলা যাবে না শ্রেয়ম।

– কেন?
– ওখানে একটা কলম আছে। যেটা দেখতে কলমের মতো হলেও ওটা আসলে কলম ভূত।
– কি.. ভূত..!!! ভয় ভয় স্বরে শ্রেয়ম জানতে চায়।
– হ্যাঁ ,কলম ভূত। তুমি পরীক্ষার খাতায় কলমটা বসালেই ভূতটা পটাপট সব লিখে দিবে।
– কি বলো সময়! কলম ভূতে সব লিখে দিবে? খুব আশ্চর্য হয়ে আগ্রহ নিয়ে সব জানতে চায় শ্রেয়ম।
– হ্যাঁ, বললাম তো সব লিখে দিবে।
– বাংলা প্রশ্নের বড় বড় উত্তরও লিখে দিবে?
– হ্যাঁ বাংলা, অংক, ইংরেজি সবকিছুই সে লিখে দিবে, কিন্তু…।
– কিন্তু কি?
– তুমি বক্সটা কারো সামনে খুলতে পারবা না, পরীক্ষার হলেও লুকিয়ে নিতে হবে। খাতা পাওয়ার পর একবার খাতার পৃষ্ঠায় বসাতে পারলেই হলো। পটাপট সব লেখা শেষ।

সময়ের কথায় শ্রেয়মের আর তর সইছে না। ইশ কালকেই পরীক্ষা চলে আসলে ভালো হতো।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই চলে যায়। শ্রেয়ম আম্মুর পাশে শুয়ে আছে চুপ করে। কখন আম্মু ঘুমাবে তা পাহারা দিচ্ছে যেন।
মধ্যরাত আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিশ্চিত হয়ে শ্রেয়ম পড়ার ঘরে যায়। কলম ভূতের প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখে।

৩.
কলম ভূতের উত্তেজনা, নানান ভাবনা, প্ল্যান করতে করতে শ্রেয়মের পরীক্ষা এসে গেলো। পরীক্ষার আগের দিন হতে শ্রেয়ম কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলো। সময়ের কথামতো কলমভূতে আসলেই কি সব লিখে দিবে? পরীক্ষার খাতায় লেখার আগে কেউ দেখে ফেললে তো তার বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভাগ্যিস প্রথম পরীক্ষা ইংরেজি। সময়ের কলমটা কাজ কতটুকু কি তা দেখা যাবে।

পরীক্ষা হলে ঢুকলো। খাতায় বৃত্ত ভরাট শেষ করলো অন্য কলম দিয়ে। প্রশ্নও হাতে পেলো। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে খুব সাবধানে পেন্টের পকেট হতে কলম বের করলো। ওমা! একি অবাক কান্ড! খাতায় কলম বসাতেই ট্রেনের গতিতে পটাপট সব লিখতে শুরু করলো! শ্রেয়ম দুপাশে তাকায়, কেউ না দেখে মতো বাঁহাত দিয়ে কলমটা আড়াল করলো। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে লেখা শেষ হলেও শ্রেয়ম মেমকে খাতা জমা দিলো না। কলম ভূতটা পকেটে ঢুকিয়ে সাধারণ কলম হাতে সময়টা শেষ করে।

একদিন পর গণিত পরীক্ষায় সে কলম ভূত নিয়ে গেলো। সেদিন আরো চমকে যায় শ্রেয়ম। যে অংক বারবার ভুল করে বলে তুর্ণা ম্যাডাম তা রাগ করে করাতো না, কলম ভূতে প্রথমেই সে অংকটা মিলিয়ে ফেললো! শ্রেয়মের ভেতর আনন্দ, উত্তেজনার সাথে ভয়ও কাজ করছে। এখনো বাংলা পরীক্ষা বাকি, কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে নিশ্চিত তাকে বাবা গ্রামীণফোনের টাওয়ার বানিয়ে ফেলবেই।

ভালোই ভালোই দুটো পরীক্ষা শেষ হলো। বাংলা পরীক্ষার আগে তিনদিন বন্ধ দেওয়ায় শ্রেয়ম ভীষণ বিরক্ত হয়। চটজলদি লিখে পরীক্ষাটা শেষ করতে তার তর সইছে না। কলমটা সে এবার একদম আলমারিতে আম্মুর শাড়ির ভাঁজে আরো ভালো করেলুকিয়ে রাখে।

৪.
বাংলা পরীক্ষার সকাল বেলা।
খুব সকাল সকাল শ্রেয়মের ঘুম ভাঙে। মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে। এই কলমভূত তাকে যেভাবে সহযোগিতা করছে, সময়কে সে ভালো একটা গিফট দিবে। মনে মনে ভাবে সময় যদি এই কলমভূত না দিতো তাকে রোদে পুড়তে হতো ,বৃষ্টিতে ভিজতে হতো, কাক,ময়নাসহ কত পাখি যে তার গায়ে টয়লেট করতো! ভাবতেই বমি আসে।গা শিরশির করে তার।

ভাবতে ভাবতে স্কুল ড্রেস পরা শেষ। কোন টেনশন ছাড়া ঝটপট নাস্তা শেষ করলো। পার্থিব ডাক দেয় তিনতলার সিঁড়ি হতে। পেন্সিল বক্স নিয়েই বের হবে। আলমারিতে কলম নিতে গিয়ে হাত পা কাঁপছে।কলম পাচ্ছে না , কোথাও কলম নেই! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না শ্রেয়ম। মাকে কিভাবে বলবে? না না কাউকে বলা যাবেনা।

পার্থিব ডাকতে ডাকতে উপরে চলে আসে।
– শ্রেয়ম কই। পরীক্ষায় দেরি হয়ে যাবে।
শ্রেয়মের কাঁপুনি বাড়লো আরো। পুরো ঘর যেন ঘুরছে। গায়ে শীত শীত লাগছে তার।জ্বর এসে যাচ্ছে।
আলমারির সব শাড়ি উল্টিয়ে ফেলে। আম্মু দরজা খুলে ঢুকলো
– কিরে শ্রেয়ম আলমারিতে কি খুঁজছিস এইভাবে?
– না মা একটা কলম ছিলো, দেখছো?
– হ্যাঁ, সেটা কালরাতে পার্থিবকে দিয়ে দিয়েছি।
– আম্মা কি.. ক.. র..ছো… বলে চিৎকার দিতেই শ্রেয়মের ঘুম ভেঙে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটাবের অভিষেক অনুষ্ঠান ৩০ শে নভেম্বর
পরবর্তী নিবন্ধবাবা মাকে