সমান অধিকার অধিকারের সাম্যতা

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আমাকে প্রথম ‘নারীবাদী’ সম্বোধন করেছিলেন আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি। সেই সম্বোধন ইতিবাচক অর্থে নয়, কটাক্ষ করে ব্যবহার করা হয়েছিল। এ-নিয়ে আমি যখন আনুযোগ করছিলাম, আমার ভাই তখন প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি যে নারীবাদী, এটা স্বীকার কর তো?’ সেদিন ওর প্রশ্নে আমি থমকে গিয়েছিলাম। এর আগে এমন সরাসরি প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। ইতস্তত করে উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। ওই সময়টায়, নারীবাদ আমার কাছে পশ্চিমা অস্পষ্ট একটা বিষয় ছিল। ‘নারী-পুরুষের সমান অধিকার’ এর চেয়ে ‘সব মানুষের সমান অধিকার’-এই মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলাম। তখন মনে হতো নারীর আবার আলাদা অধিকার কেন লাগবে? সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হলে তো নারীর অধিকারও নিশ্চিত হবে।
আপাত লিঙ্গ বৈষম্যহীন পরিবারে বড় হওয়াতে, নারী পুরুষের বৈষম্য বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল। আপাত বলছি এই জন্যে, আমি একজন নারী হিসেবে, ঘরের মেয়ে হিসেবে বৈষম্যের শিকার না হলেও, আমার মা, মাসি, মামী মানে ঘরের অন্যেরা কিন্তু, তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যেটি অনেক ক্ষেত্রে তারা বুঝতেও পারেনি। আমার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকে ‘নারী’র সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থান অন্যরূপে ধরা দিল। সকল নিয়ম-কানুন আবর্তিত হতে দেখলাম নারীকে ঘিরে। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল যে, বিয়ে যেন একটা মেয়ের এক জীবনে দ্বিতীয় জন্ম। বিয়ের পর মেয়েটা আর মেয়ে থাকে না, হয়ে যায় ঘরের বউ। আর ঘরের বউয়ের তো প্রতি পদে পদে শেকল। তবে এই প্রক্রিয়ায় খুব অদ্ভুতভাবে পাল্টে যায় প্রেমিকের ব্যবহার। প্রেমিক হয়ে যায় স্বামী, আর স্বামীর চরিত্রের সফলতা হল স্ত্রীর দমন। তবে, ঢালাওভাবে এখন আর হয়তো এভাবে বলা যায় না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনা এবং ব্যবহারের পরিবর্তন এসেছে। তো, সেই ২০১৫ এ আমার বিয়ের ঘটনা আমাকে নারীবাদ নিয়ে আলাদা করে ভাবতে বাধ্য করেছে। এবার ‘সমান অধিকার’ এর সাথে জানলাম ‘অধিকারের সাম্যতা’ বা ‘ন্যায্য অধিকার’ নিয়ে। নারী-পুরুষের ‘সমান অধিকার’ এবং ‘অধিকারের সাম্যতা’ বা ‘ন্যায্য অধিকার’ বিষয়গুলো আসলে কি? এ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানলাম, ‘সমান অধিকার’ হল একজন মানুষের যা কিছু অধিকার আছে একজন নারী সে অধিকারগুলো একজন পুরুষের মতো সমানভাবে ভোগ করবে। যেমন, আমাদের দেশে এখনো নারী শ্রমিকেরা পুরুষের চেয়ে কোনো কোনো অঞ্চলে কম মজুরী পায়। নরওয়ের মত উন্নত পশ্চিমা দেশে এখনো একই কাজের জন্য নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি বেতন পায়। আবার আমরা যদি বিনোদন জগতের খেলোয়াড়দের দেখি, সেখানেও একই বৈষম্য বিরাজমান। আমেরিকান শ্রম অর্থনীতিবিদ ডঃ জন প্রায় ৩০০ অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন যে, একজন অভিনেত্রী যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, তাকে তার সমপর্যায়ের অভিনেতা থেকে অন্তত এক মিলিয়ন ডলার কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। কিন্তু, ডঃ জন তার গবেষণায় পেয়েছেন, কেবল নারী হবার কারণেই এই পারিশ্রমিকের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে অভিনেত্রীদের। তো, নারীবাদ এই ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক দেবার কথা বলছে। আবার ঘরে থাকেন যে নারীরা, তারা তো অর্থ উপার্জন করেন না। সেক্ষেত্রে তো পরিবারের পুরুষের উপর উপার্জনের সকল চাপ থাকে। এ পরিস্থিতিতে, নারীবাদ বলছে নারীর কাজের মূল্যায়ন করতে। একজন নারী ঘরে যে কাজ করে এবং যে সময় দেয় তাকে যদি সেবামূল্যে রূপান্তর করা যায়, তাহলে পরিবারে তার অর্থনৈতিক অবদান পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে। অনেক পুরুষ বলে, তাদের অর্থ উপার্জন করতে ইচ্ছে না করলেও, তারা বাধ্য হয় এই চাপ নিতে। তা না হলে, তাদের উপর পারিবারিক-সামাজিক চাপ তৈরি হয়। এক্ষেত্রেও নারীবাদ পুরুষের উপর পরিবারের উপার্জনের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে অবস্থান করে। নারীবাদ সকল অবস্থাতেই নারী এবং পুরুষের সমান দায়িত্ব ভাগ করে নেবার কথা বলে, পুরুষকে দমন করার কথা বলে না।
নারী আর পুরুষ যদি সকল অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারে, তাহলে ‘অধিকারের সাম্যতা’ বা ‘ন্যায্য অধিকার’ এর প্রসঙ্গ কেন আসবে? আবারও হলিউডের সেই গবেষণায় ফিরে যাই। হলিউডের অভিনেত্রীদের কম পারিশ্রমিকের ব্যাপারে অনেকে বলে থাকেন যে, নারী অভিনেত্রীরা বেশি চায় না, তাই বেশি পায় না। কিন্তু, হলিউডে অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা নিজেরা পারিশ্রমিক দাবী করে না, তাদের হয়ে তাদের এজেন্সি এ-বিষয়ে আলোচনা করে। একই এজেন্সি এবং কখনও কখনও একই ব্যক্তি একজন অভিনেতা এবং একজন অভিনেত্রীর পারিশ্রমিক নিয়ে আলোচনা করে। তারপরেও কেন, পারিশ্রমিকের পার্থক্য হয়? একমাত্র কারণ, ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়।
অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে তার এজেন্সি কমে রাজি হয়ে যায় প্রচলিত চর্চা অনুযায়ী। এখানেই ‘সাম্যতা’ বা ‘ন্যায্যতা’র প্রবেশ ঘটে। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলোর কর্মীদের লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে, তাদের পরিষ্কার নির্দেশনা দিতে হবে যেন লিঙ্গভেদে পারিশ্রমিক কমে তারা চুক্তি না করে, প্রয়োজনে সকলের চুক্তিপত্র প্রকাশ করতে হবে স্বচ্ছতার জন্য। আমাদের দেশের উদাহরণ যদি দেই, স্কুল-কলেজে মেয়েদের জন্য আলাদা যে ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটি করা হয়েছে মেয়েদের শিক্ষায় উৎসাহ দেবার জন্য। বাংলাদেশে মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করেছে মাত্র ১০০ বছর আগে থেকে। এখনো এদেশে প্রায় ৫৭% মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়। তাদের যদি আর্থিক সুবিধা দিয়েও স্কুলে পাঠানো যায়, তাতে একদিকে যেমন নারী শিক্ষার হার বাড়বে আবার অন্যদিকে নারী শিশুর বাল্যবিয়ে কমবে। এক কথায় বললে, সম-অধিকার নিশ্চিত করতে এই যে বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেয়া, এটিই অধিকারের ‘সাম্যতা’ বা ‘ন্যায্যতা’।
সব মানুষের অধিকার তখনই নিশ্চিত হবে যখন নারীকে কেবল নারী নয়, বা পুরুষকে কেবল পুরুষ নয়, সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। নারী পুরুষের চেয়ে হীন, বা পুরুষ নারীর চেয়ে উচ্চতর এই ভাবনা থেকে যেদিন এই পৃথিবী মুক্ত হবে, সেদিন আর আলাদা করে নারীবাদের প্রয়োজন হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅল্পের জন্য পারমাণবিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচেছে বিশ্ব : জেলেনস্কি
পরবর্তী নিবন্ধনারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ের পথ সুগম হোক