এক অনলাইল সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের অনলাইনভিত্তিক সকল উদ্যোগের ছত্রিশ শতাংশেরও অধিক উদ্যোগ পরিচালিত হচ্ছে নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা। এটি নিশ্চয় আশাব্যঞ্জক খবর। ওদিকে দেশে প্রায় দশ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং প্রায় আটষট্টি লাখ কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মাত্র সাত দশমিক একুশ শতাংশ নারী-উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াল? এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই আমরা এগুতে চেষ্টা করি।
বাংলাদেশে সরাসরি কিংবা অনলাইন- দু’ধরনের ব্যবসাতেই নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক বাড়লেও উদ্যোক্তারা বলছেন নারী হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করা কিংবা ব্যবসা সমপ্রসারণ করার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাধাও বাড়ছে। নারীর জন্য সহায়ক কর্মপরিবেশ তৈরি এবং নানাবিধ প্রণোদনার কারণে দেশে নারী-উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে কর্পোরেট সাপ্লাই চেইনে তথা ভোক্তা বাজারের মূল প্রবাহে নারী-উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ খুবই কম।
এদিকে বাংলাদেশের নারী-উদ্যোক্তারা কর্পোরেট ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত নেই বললেই চলে। গুণগতমানসম্পন্ন যুতসই পণ্য উৎপাদন করতে না পারা, প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব, উপযুক্ত বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত হতে না পারা, কর্পোরেট হাউজের চাহিদা সম্পর্কে তথ্যের অভাব, অসম বাজার প্রতিযোগিতাসহ নানা কারণে নারী-উদ্যোক্তারা কর্পোরেট হাউজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম না থাকা, নারী-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাজ করতে সক্ষমতার ঘাটতি, তাদের পণ্য সম্পর্কে তথ্যের অভাব, নারী-উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করার সুদূরপ্রসারী ফলাফল উপলব্ধি করতে না পারার কারণে কর্পোরেট হাউজগুলোও নারী-উদ্যোক্তাদের পণ্য ক্রয় করতে পারে না।
দেশীয় এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, পণ্যের বাজার সংযোগ বা বাজারজাতকরণ নারী-উদ্যোক্তাদের জন্য অন্যতম প্রধান একটি বাধা। ব্যবসা শুরুর প্রথম পর্যায়ে এই সমস্যা আরও প্রকট। গবেষণায় দেখা যায়, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সাইত্রিশ শতাংশ নারী-উদ্যোক্তা পুঁজি সংকটের কথা উল্লেখ করলেও বিশ শতাংশ নারী-উদ্যোক্তা তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে পণ্যের বাজারজাতকরণকে চিহ্নিত করছেন। সমপ্রতি কর্তৃপক্ষ ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক নজরদারি এবং নিরাপত্তা আমানত রাখার সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য হয়রানির মাত্রা বাড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন দেশের কয়েকজন প্রথম সারির নারী উদ্যোক্তারা। তবে সরকারের দিক থেকে আগেই বলা হয়েছে যে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি প্রকৃত উদ্যোক্তাদের কাজের সুযোগ করে দিতেই এসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ আসার পর কর্তৃপক্ষ এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এই সূত্রে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়, ঋণ বা অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনেক সময় উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদানের সহজ ব্যবস্থা তৈরি করার বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।
তাছাড়াও সরকারি সহযোগিতা, নারী উদ্যোক্তাবান্ধব বাজেট থাকলে নারীরা সফলভাবে বিনিয়োগে আসবেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স সংক্রান্ত হিসাবাদি, জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স, ব্যাংক ঋণ, বিএসটিআই অনুমোদন, ট্রেড লাইসেন্সের কাজ সহজীকরণ করলে এবং সেই সাথে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত কিছু আয়োজন করলে তারা তাদের কাজ সামনে তুলে ধরতে পারবেন। তাতে করে আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য সামনাসামনি সবাই দেখতে পারবেন এবং এতে করে নেটওয়ার্কিং-এর একটা প্ল্যাটফর্মও তৈরি হয়। তাই একটা প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কেবল শুধু বরাদ্দই নয়, একটি সুন্দর ও সুস্থ নারী উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতি তৈরি করতে প্রয়োজনীয় রূপরেখা ও দেশের অর্থনৈতিক বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থনীতির পালে নারী উদ্যেক্তারা যে হাওয়ার যোগান দেন সেটিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে, আমলে নিতে হবে।