অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা যাদের খবর আমরা রাখিনি

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৪ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অর্ধ শতাব্দীর থেকেও বেশি সময় পার করলাম স্বাধীনতার। অথচ দুর্ভাগ্যবশত আজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক খেলা থেকে বের করে এনে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলাম না! দুই দলের দুইরকম ইতিহাস! ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে যায়, স্বাধীনতার নেতা বদলে যায় এমন আয়োজন শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব! এই পাল্টাপাল্টি, রেষারেষিতে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে যাচ্ছে। যেগুলো ইতিহাসে উঠে আসা উচিত ছিল। কূট বিতর্কের প্রতিযোগিতায় আড়ালে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছু, গবেষণা হচ্ছে না! অনেক কিছুই অনাবিষ্কৃত থেকে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের উপর বিস্তৃত কাজ আমরা দেখতে পাই না। এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল একটা তালিকা হয়েছে এমন দাবি সরকারও করতে পারছে না! এত এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়ে নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রইলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে নারীপুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছে,সকল শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে কিছু রাজাকার, আলবদর ছাড়া। নারীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিলো, কি পরিমান নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন এসব নির্মোহ ইতিহাসের স্বার্থে আমাদের জানা প্রয়োজন। গবেষণার প্রয়োজন। এসব গৌরবগাথা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

নারীদের তৎকালীন অবস্থান থেকে যুদ্ধ করা কতটাই কঠিন ছিল তা আজকের এই সুবিধাভোগী প্রজন্ম বুঝতে পারার কথা নয়। নারী প্রথমত তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তার পরিবারের সাথে যুদ্ধ করেছে, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান বলতে যে চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় তা অসম্পূর্ণ। নারী কেবল ধর্ষিত হয়নি রুখেও দাঁড়িয়েছিলো। নারীদের অসীম সাহসী যে ভূমিকা বরাবরই তা আড়ালে চলে যায়। সেটা পুরুষ নির্মিত ইতিহাস বলেই হয়তো! নারী যুদ্ধ করেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ যেমন করেছে, রান্না করে খাইয়েছে, ঘুরে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছে,কন্ঠ সৈনিক হিসেবে কাজ করেছে,কলম সৈনিক হিসেবে কাজ করেছে সবকিছুতেই নারীর অবদান ছিল। পুরুষদের তুলনায় নারীদের এযুদ্ধ অনেক বেশি কঠিন ছিল। যেসব নারীদের স্বামী সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই অবস্থায় নারীরা প্রথম চেষ্টা করেছে, বেঁচে থাকা সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখতে। অনন্যোপায় হলে তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সকল সঞ্চয় ফেলে যখন চলে যেতে হয় দূরদূরান্তে, দেশান্তরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এসব পরিবারগুলো আঁকড়ে ধরে রাখা কতটা নিরাপত্তাহীন,কতটা সংকটময় সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বলতে পারার কথা নয়। নারী সংগঠক হিসেবে যারা কাজ করেছেন তাঁদের অনেকের নাম হয়তো আমরা জানি। ভারতে অবস্থান করে এবং দেশের মধ্যে থেকে অস্ত্র চালানো শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে সেক্টরে বিভিন্ন বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে বহু নারী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন তাদের কথা আমাদের আজও অজানা। তাদের মধ্যে অনেক আদিবাসী নারীও ছিলেন। তারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এসব কখনো আলোচনায় আসেনি। অথচ তাদেরও রয়েছে অসামান্য অবদান। কয়েকজন আদিবাসী অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নারীর কথা সমপ্রতি জানা যায়, যার একজনের নাম কাঁকেট তিনি খাসিয়া সমপ্রদায়ের। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। তিন মাস সেনাক্যাম্পে অকথ্য নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন। রাখাইন নারী প্রিনছা খে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সেবিকার কাজ করতেন এক পর্যায়ে ধরা পড়লে তার উপর পাশবিক নির্যাতন শুরু হয়। সহ্য করতে না পেরে গোপনে বিষ সংগ্রহ করে পাকিস্তানী সেনাদের খাবারে মিশিয়ে ১৫ জন পাকিস্তানী সেনাকে হত্যা করেন। তিনিও ছিলেন একজন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এইরকম অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে। তাদের খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা চাই সরকারিভাবে এসব কাজগুলো হোক। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা আমাদের বাতিঘর হয়ে থাকুক। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আমরা বুকে ধারণ করি দেশ কখনো পিছিয়ে যাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইয়ান ওয়াং প্রেস্টন : এ সময়ের নদীর গল্প
পরবর্তী নিবন্ধদেওয়ান বাজার ওয়ার্ডে বিন বিতরণ