শিরিন নেশাত বিরোধিতার সুরকার

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

আমাদের প্রত্যেকের কাজই নিজস্ব অভিজ্ঞতার সমীপে। পরিমিতিবোধ সেকাজকে সমৃদ্ধ করে তোলে। স্বপ্ন এবং বাস্তবতার তফাৎও এখানে। স্বপ্নেরা বাস করে ভয়ভাবনায় আর বাস্তবতা সে পরিমিতিবোধ যার রেশ ধরে এক কদম সামনে যাওয়া যায়। সম্মুখের পথ কতটা জটিল বা সহজ তা মূলত তৈলাক্ত বাঁশেবানরের নাচের মতো। সহায় সাহস এরপর অভিজ্ঞতা। খুব আয়েশ করে কারও ঝুঁকি নেবার কথা নয়, বিরোধের সুর ওঠে, প্রকৃতিতে এ বিরোধিতাও সরলস্বাভাবিকসহজ। কৌতূহলের মতো, প্রশ্নের পর প্রশ্ন এরপর যৌক্তিক বিশ্লেষণে সৃষ্ট নতুন প্রশ্ন কিংবা ইমেজ। সত্য বা মিথ্যের হিসাব এসবের বাইরে, দর্শকের চাবিতে।

প্রতিনিয়ত ভাবা এবং প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া একটি প্রক্রিয়া। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে হয় না, আঘাত পায় বটে, যাদের সৎ সাহসের অভাব আছে এবং কিছু গতানুগতিক ধারাক্ষমতায়ন তৈরি করেছেন, এ বৈপরিত্যে কাজই পারে সমস্তকিছু চুরমার করে দিতে, দমকা হাওয়ায় নতুন পাল তুলতে।

ইরানের তেহরানেও সে দমকা হাওয়া বয়ে চলেছে, ‘মানুষধর্ম’ যখন কেবল বন্দী শিবিরের আস্তানা গড়ে, তখন কেবল ইমেজের শব্দই পারে শব্দের তীব্রতাকে অতিক্রম করতে। ইমেজের এশব্দকে ভিন্ন জানালা থেকে দেখিয়েছিলেন শিরিন নেশাত। যার কাজের মূলে রয়েছে ধর্ম,পাশ্চাত্য দর্শন, নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র, আধুনিকতার পরীক্ষানিরীক্ষায় বৈসাদৃশ্য। এ বিরোধ ভাঙ্গনের নয়, সেতুবন্ধনের, ফাঁকা স্থান পূরণের।

তেহরানের ছোট্ট এক গ্রামে ১৯৫৭ সালে জন্ম শিরিন নেশাতের। সতের বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ করতে ছাড়তে হয়েছে নিজের মাটি। তিনি বর্তমানে একজন কনটেম্পরারি ভিউজুয়াল আর্টিস্ট, অধিক পরিচিত আলোকচিত্রী হিসেবে। তবে মুভিং ইমেজ নিয়েই বেশি কাজ করতে দেখা যায় তাকে। ১৯৯৩ সালের দিকে নেশাতের আলোকচিত্র আলো ফেলে, ‘আনভেইলিং (১৯৯৩)’ এবং ‘ওমেন অফ আল্লাহ(১৯৯৩৯৭)’ তে দেখা যায়, ইরানের ইসলামিক ভিত্তি এবং কালচারের সাথে নারীবাদের যে ধারণা তার বিশ্লেষণ খুঁজে ফিরছেন তিনি।

তাঁর কাজে খুব ভারি রাজনৈতিক আলাপ বা জটিলতা যদি একজন দর্শক নাও নিতে চান, তবুও আবেগের যে মাত্রা সেটি নিশ্চয় ছুঁয়ে যাবে। যদিও শিরিন নেশাতের কাজ মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক। বিমূর্তভাবে জেন্ডার, আইডেন্টিটি এবং সোসাইটির যে প্রাক্‌ধারণা তাকে প্রশ্ন করে চলেছে।

ওমেন অফ আল্লাহ’তে শিরিন নেশাতের পরিপক্ক কিছু ধারণার গাঢ়ত্ব প্রকাশ পায়। পার্সিয়ান ক্যালিগ্রাফির সাথে নারীর শরীরের যোগসূত্র এক দীর্ঘ বিরোধিতার কবিতা যেন।

পর্দার দুধারে দুই বস্তু, হাজার কোলাহল, সাদা পোশাকের সকলে উন্মুখ যাত্রী,কালো’রা বিভ্রান্ত, ফাঁক দিয়ে সূর্যমুখীর মত একটি মুখ কেবল পেছনে ফিরে আছে, এই পেছন মাড়িয়ে তাকানোটাই আলো, আশার আলো। ‘ফেরভোর সিরিজ’এ সে আলোতে দৃষ্টিপাত করেছেন শিরিন নেশাত।

বন্দুকের নল তাক করে যে স্বাধীনতা হরণ করে, সে বন্দুক আর নারীর শরীরকে স্টেইজ করে ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আলোকচিত্রে নিজস্ব ধারা শিরিন নেশাতের কাজ ও সমসাময়িক নারীবাদের আন্দোলনকে আরো সমৃদ্ধ করছে। নারীর অকথ্য কথা, হাত দিয়ে ঠোঁটে স্পর্শ তবু না বলতে পারার চাপা কষ্ট, চোখের ভাষা সবই তাঁর ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে খোদাই হয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে নেশাত ইরানি নারী লেখক ফারুকজাদএর কবিতাতেই নির্ভার থাকে। ‘ফুল নিয়ে কেউ ভাবছে না/কেউ মাছগুলোর কথা ভাবছে না/কেউই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না, বাগান মৃত্যুর পথে/ধীরে ধীরে আমরা ভুলতে বসেছি/একদা এ বাগান ছিল সবুজের আড়ত।

শব্দ এবং পুঁথির যে ধাঁধায় আমাদের এতকাল বেঁধে রেখেছে তার সার নিয়েই নেশাত তার আলোকচিত্রে ক্যালিগ্রাফিকে প্রাধান্য দেয়। নিজের হাতে লেখা ক্যালিগ্রাফিগুলো ভিউজুয়াল আর্টের যে শক্তিশালী আবহ তা নেশাতের নারীবাদী সত্তা সম্পর্কে নিখুঁত প্রমাণ দেয়, ইসলামি রেভ্যুলেশনের এতুঙ্গে এধরণের বৈপ্লবিক ক্যালিগ্রাফি আলোকচিত্রের জগতে বেশ নতুন এবং উপযোগী।

ভিউজুয়াল ইন্সটলেশনে এসবের রূপায়ন হয় নেশাতের ‘টার্বুলেন্ট’, ‘রেপচার’, ‘ফেরভোর’র কাজগুলোতে।

শিরিন নেশাতের প্রথম এক্সিবিশন হয় ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে। গ্র্যান্ড প্রিক্স, ভেনিস বিয়েনালে, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অফ ফটোগ্রাফির মতো পুরস্কারও আছে তালিকায়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শিরিন নেশাত জনপ্রিয়। নারীবাদী এবং তরুণদের ভীড়েও তাকে প্রভাবশালী একজন আলোকচিত্রী হিসেবে দেখা যায়।

নারীদের নিয়ে কাজ এবং পড়াশোনায় শিরিন জানতে পারে, এ প্রক্রিয়া মূলত নিজের হৃদয়ের গভীরে জাতির সংস্কৃতিকে জানার একটি মাধ্যম। একই সাথে এটি অস্ত্র, বিরোধী সংস্কৃতির সাথে লড়াইয়ের। যখনই ছবি তুলেছেন, ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে নির্দিষ্ট বার্তা প্রদানেও সচেষ্ট ছিলেন, যেগুলোর মধ্যে ছিল ইরানি নারীদের দেখা নিজস্ব কিছু কবিতাও। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নেশাত মনে করেন, সকল ইরানি আর্টিস্টদের ফর্মই রাজনৈতিক এবং রাজনীতিই আমাদের আলাদা করে।

শিরিন নিশাত তার কাজকে যেমন প্রাসঙ্গিক করে তুলে এনেছেন তেমনই সমালোচনার সর্বোচ্চতে নিয়েছেন। কেননা যে কোনো প্রতীকই স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা উভয়ের স্লোগান দেয়। তিনি একজন বিরোধিতারই সুরকার। বিরোধিতায় যুক্তি দেখান এবং রাজনৈতিকভাবে অন্যকে সরাসরি বিদ্ধ করেন। আলোকচিত্র এবং নারীবাদের শক্তিকে আরো উজ্জীবিত করতে বিরোধিতার এই সংগ্রাম এখনো জারি রেখেছেন নেশাত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপচয়ে যায় ওই বিপুল শক্তি
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় অনাবাদী একশ বিঘা জমিতে ফসল উৎপাদন