ইয়ান ওয়াং প্রেস্টন : এ সময়ের নদীর গল্প

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৪ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

বিস্তৃত প্রান্তরের বিপরীতে, হাহাকার করা মায়ের আর্তনাদের পাশে একজন সন্তানের শব্দহীন সঙ্গ ছাড়া এপৃথিবীতে আর কি আছে! নদীর মা কিংবা মায়ের নদী, বিশালতায় মহাকাশ সম। অজানা গন্তব্যে ছুটে চলে যে নদী, তার ঢেউয়ে জায়গা মিলে প্রায় অনেকদিন পর। শতবার শাটার চেপে ইয়ান ওয়াং প্রেস্টন জানতে পেরেছিল, কি করতে চান তিনি।

স্তরের পর স্তর জমে, কত শত মাত্রায়, ল্যান্ডস্কেপে শাটার চাপার আনন্দ আছে নিশ্চয়। মানবের সাথে ভূমির, নদীর সাথে মায়ের যে সম্পর্ক, তার অন্বেষণ প্রেস্টন করেছেন ফটোগ্রাফির মাধ্যমে। ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্টেশনের প্রত্যেক ইমেজেই প্রেস্টন নিজের ভূমি, জলবায়ু, অভিবাসনের আত্মকথাকে খুঁজে এনেছে। স্থিরচিত্রের পাশাপাশি সাউন্ড, পারফরম্যান্স, ইন্সটলেশন, মুভিং অবজেক্টের মাধ্যমে নিজের অনুভূত চিন্তাগুলোকে দর্শকের সামনে আনতে চেয়েছেন সবসময়। আধুনিক ভাবনায় যতভাবে একজন দর্শককে আকৃষ্ট করা যায়, প্রেস্টন তার সবটাই করেছেন বলা চলে।

নদীর ধারে কাজে ব্যস্ত পথিক, নদীতেই কাজ চলছে বাঁধের। সে পথিকের মতো প্রেস্টনও দীর্ঘ সময় দিয়েছে চীনের ছ’হাজার কিলোমিটারের ছাং চিয়াং নদীর তীরে। প্রতি একশ কিলোমিটারের পর ছন্দাকারে ৬৩’র বেশি স্পটে ছবি তুলেছেন। এনদীর অববাহিকায় আছে পাহাড়ের মিলন। তবুও এনদীর রঙ যেন আমার কর্ণফুলির হিম শীতল স্তব্ধতার গল্প বলে। অভয়মিত্রের যে ঘাটে বাদাম চিবিয়ে মাকে সঙ্গ দেওয়া হত, সেখানে এখন উঁচু ইমারত, লম্বা ব্রিজ আর পাহাড়উঁচু জাহাজ। প্রেস্টনের কাছেও ছাং চিয়াং ধরা দিয়েছে বড় মা হিসেবে। যে মায়ের সাথে প্রায় হাজার বসতির বাস। ‘মাদার রিভার’ তাই ইয়ান ওয়াং প্রেস্টনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ।

প্রকৃতি আর মানুষের যে বন্ধন তার সার প্রেস্টনকে উর্বর করেছিল সবসময়। রূপান্তরিত সে ভাবনার খোরাককে ফটোগ্রাফিক ইমেজে এনেছেন ‘ফরেস্ট’ সিরিজের মাধ্যমে। দীর্ঘ আট বছর সময় দিয়ে বের করেছেন চীনের শহরগুলিতে বন পুনর্গঠনের রাজনীতি ও প্রকৃতির পরিবেশ ধ্বংসের এজেন্ডাগুলো। প্রেস্টন প্রথমে প্রতিস্থাপিত পুরানো গাছ, কংক্রিট শহর এবং উন্নয়নশীল জনগণের যাত্রাপথ নথি করে কিছু ছবি তুলেছিলেন। পরবর্তীতে তার কাজ প্রসারিত হয়, উদ্ভিত ও বন্যের রঙে পরিবেশকে পুনঃরুদ্ধার করার প্রচেষ্টায় ল্যান্ডস্কেপে প্রেস্টন নিজের সর্বোচ্চ বাহাদুরি দেখান। ফলে সমসাময়িক যুগে নগর বনায়ন ও প্রকৃতির পুনর্নিমাণে জটিল সব প্রশ্নের উত্থাপন হয়।

প্রেস্টনের ছবিতে দেখা যায়, গাছেদের গায়ে পলিথিন মোড়ানো, কোথাও গাছ কেটে গুড়ি দিয়ে সাজিয়েছেন অনেকে বারান্দা কিংবা সারিসারি গাছের মাথা কাটা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির এছবি আপনাকে ভাবাবে। ইমেজের গল্পের মাহাত্ম্য এখানেই, আলোকচিত্রী স্থির সব চিত্রেও আপনাকে চরম অস্থির করে তুলতে পারে, আপনার ভাবনায় পোকার মতো কামড় বসিয়ে বলতে পারে, এরপর তুমি বাঁচবে কি!

পরিবেশের অন্যতম অবজেক্ট মানুষকে ঘিরেও প্রেস্টনের রয়েছে নানারকম ভিজ্যুয়াল আর্ট। নিজের কাজের সাথে সে ভিজ্যুয়াল আর্টকে ঘিরে তৈরি করেছেন ইন্সটলেশন। ‘স্ট্রিট ভিউ’ সিরিজ এধরণের কাজ, প্রেস্টনকে এনে দিয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। এটি মূলত দীর্ঘ ডিজিটাল উইন্ডো ডিসপ্লে যেখানে কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফের দেখা মিলে। পুরোনো অনেক ধারণা সরাসরি নাকচ না করে, প্রেস্টন মানুষের বিচিত্র রূপ, সংঘবদ্ধতাকে তুলে এনেছিলেন। এর ছাপ ছিল, ‘রেড পিকচার’ সিরিজেও। যেখানে পেপার জিওগ্রাফির মাধ্যমে ছাং চিয়াং নদীর ইকোসিস্টেমে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ মেলে।

ওয়াইল্ডারনেস এক্সপেন্সেস’ শব্দটির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় প্রেস্টন, বছরের পর বছর পাথর উত্তোলনের ফলে যে চূড়া ভেঙ্গে নিঃশেষ হচ্ছিল, তার সাদাকালো জীবন চিত্র প্রেস্টনকে আরো বেশি একজন মানবিক পরিবেশকর্মী হিসেবে প্রতিফলিত করে।

আলোকচিত্র’কে সময়ের দলিল বলা হয়, একজন আলোকচিত্রী কেন ছবি তুলেন তার উত্তর প্রেস্টনের কাজ। মরুভূমিকে আরো মৃত করছে যে রাজনৈতিক শক্তি তাকে নিশ্চয় দুমড়ে দিতে প্রেস্টনের ছবি জরুরি ভূমিকা রাখছে।

প্রেস্টনের কাজ প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। ‘হান্ড্রেড হিরোইনস’, ‘রয়েল ফটোগ্রাফি সোসাইটি’, ‘থ্রি শেডোস ফটোগ্রাফি’সহ অসংখ্য পুরস্কার।

দেশবিদেশে প্রেস্টনের কাজ প্রদর্শিত হয়েছে সম্মানের সাথে। ভেনিস মিউজিয়াম, জর্জ মিউজিয়াম, ওয়াহান আর্ট মিউজিয়াম, গ্যালারি অফ ফটোগ্রাফি আয়ারল্যান্ড, ইমপ্রেশন গ্যালারি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। প্রেস্টনের কাজ নিয়ে আর্টিকেল আছে ‘ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফ অর্গানাইজেশন’ , ‘ব্রিটিশ জার্নাল অফ ফটোগ্রাফি’র মত ওয়েবসাইটেও। প্রেস্টনের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত শর্ট ফিল্ম আছে, মিউজিয়াম প্রোডাকশনের ইউটিউব চ্যানেলে; ‘ম্যাকিং ইন্ট্রোডাকশন; ইয়াং ওয়াং প্রেস্টন’ সিরিজে।

প্রেস্টন নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করেছে যেখানে কাজ শুরুর পূর্বে যথেষ্ট গবেষণা করেন এবং স্নায়ু থেকে স্নায়ুর যে বোঝাপড়া তা আগেই সেরে নেন। তার কাজ শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে নিজস্ব অবস্থান অর্জন করেছে সময়ের সাথে। একজন শিল্পীর মানবতার যে ইঙ্গিত তা প্রেস্টনের কাজে প্রকাশ পায়।

চীনে ১৯৭৬ সালে জন্ম ইয়ান ওয়াং প্রেস্টনের। চিকিৎসক পরিবারে জন্মানো প্রেস্টন নিজেও একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীতে ইউ কে তে অভিবাসী হিসেবে আসেন ২০০৫ সালে, মূলত তখনই একজন আলোকচিত্রী হিসেবে নিজের জীবন ভিন্ন মোড় নেয়। মাস্টার্স এবং পি এইচ ডি করেন ভিজ্যুয়াল আর্ট ও ফটোগ্রাফির উপরে। পরে শিক্ষকতাও করেছেন এবিষয়ে।

ছোটবেলা থেকেই প্রেস্টনের ফটোগ্রাফিতে বিশেষ আগ্রহ ছিল। আধুনিক ভাবনার প্রেস্টন কখনোই পরিবেশ ভাবনার বিপরীতে যাননি। বরং যা কিছু সুন্দর, সরল, সত্য তাকে সাহসের সাথে তুলে এনেছেন নতুনভাবে। যেকোনো ভাবনাই প্রেস্টনকে ভাবায় তবে নতুন ভাবনায় এগিয়ে ছিলেন প্রেস্টন। বর্তমানে আলোচিতসমালোচিত অনেক মুভমেন্টের সাথে জড়িয়েছিলেন নিজের নাম, প্রকাশ করেছিলেন নিজের জায়গা। কাজের তালিকায় তাই ‘মাদার রিভার’, ‘ফরেস্ট সিরিজ’, ‘স্ট্রিট ভিউ’র পাশাপাশি আছে ‘মাউন্টেন লাইট’, ‘পাবলিক লাইফ’, ‘হি এন্ড শি’, ‘শি ড্রিমস’ এর মতো কাজও।

ইয়ান ওয়াং প্রেস্টনকে আপাতত আলোকচিত্রীর পাশাপাশি পরিবেশকর্মী বলছি তবে তিনি একজন আধুনিক নারীবাদীও। তাঁর কাজ ‘হি এন্ড শি’ তে প্রেস্টন বদ্ধমূল কিছু ধারণাকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে হাজির করেন। ফলে ছবি তোলার এযাত্রায় পুরুষ এবং নারীর মধ্যে বোঝাপড়ার সহজাত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।

আলোকচিত্র শিল্পের যে জায়গা, সেখানে বর্তমানে প্রেস্টন একজন উত্তরআধুনিক নাম। ইয়ান ওয়াং প্রেস্টন ভাবেন, ছবি তোলা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজের ভাবনা ও ভুল ধারণাকেও ঝালাই করা যায়, ফলে ছবি কেবল একটি বিশেষ মুহূর্তের না হয়ে, মানুষের সাথে প্রকৃতির যে রস তার স্বচ্ছ দর্পণ হয়ে প্রতিফলতি হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুশিক্ষিত যুব সমাজই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধঅসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা যাদের খবর আমরা রাখিনি