শিক্ষকের গলায় জুতার মালা : কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে সমাজ

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | শনিবার , ২ জুলাই, ২০২২ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা পৃথিবীর সেরা সম্পর্কের একটি। মা-বাবা জন্ম দেওয়ার পর সন্তানকে মানুষ করতে সমাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদেরকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে তার মধ্যে মনুষ্যত্ব সৃষ্টি করেন এ কারিগররা। সম্পর্ক যা-ই হোক, প্রত্যেকের মানবিক গুণাবলি, আনুগত্য, অনুশাসন ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাভক্তি খুব দরকার। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের মধ্যেও এগুলো থাকা অপরিহার্য। কিন্তু দিন দিন এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় দেখেছি স্কুলে একসময় কড়া শাসন ছিল, শিক্ষক বেত্রাঘাতও করতেন যথেষ্ট মাত্রায়। শিক্ষকদের সম্মান সব সময় সবার ঊর্ধ্বে ছিল। পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে শাসন কাম্য হলেও বেত্রাঘাত উঠে গেছে বললেই চলে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাবে সামাজিক পরিস্থিতি পুরো বদলে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক আর শাসন করার এখতিয়ার রাখেন না। শিক্ষক হলো ক্ষমতাহীন ও ছাত্র হলো শাসন বিহীন। সামাজিক অবক্ষয়ের এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা।

সম্প্রতি আমরা দুটো ঘটনা পর্যালোচনা করলেই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়া ও সামাজিক অবক্ষয়ের এ দিকটা আমরা দেখতে পাই। প্রথমতঃ দেখেছি ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ। নিহত শিক্ষক কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতিও ছিলেন। কলেজে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়ে দশম শ্রেণির ওই বখাটে ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিত শিক্ষকের ওপর হামলা চালায়। জানা যায় প্রথমে ওই ছাত্র শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে এবং পরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। সভ্য সমাজে এটা কোনোভাবে মানা যায়? নৈতিক অবক্ষয়ের কোনো পর্যায়ে গেলে আমরা ধরনের ঘটনার সাক্ষী হলাম! নিহত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি দেখেন। হয়তো নৈতিকতা শেখাতে ঐ ছাত্রকে শাসন করেছিলেন। আমরা জানতে পারলাম দশম শ্রেণির ওই ছাত্র নিয়মিত ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় তাকে বোঝালেও সে সংশোধিত হয়নি। হয় তো আগের এমন কোনো বিষয় নিয়ে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। শাসন করলেই ক্ষোভ জন্মানোর কারণে শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা একজন স্বাভাবিক ছাত্রের দ্বারা সম্ভব না। সে হয়তো কারো দ্বারা প্ররোচিত, নয়তো এমন এক বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশে বড় হয়েছে। ঘটনা পরবর্তী উক্ত ছাত্রের বাবার কলেজে গিয়ে শাসানো, ্‌ঔদ্ধত্য আচরণ ও প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা দ্বারাই বোঝা যায় পারিবারিক ভাবে অসহনীয়, অস্থিরতাপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। আরো জানতে পারলাম অভিযুক্ত শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাং সদস্য, স্কুল কমিটির সভাপতির নাতি। ক্ষমতা দেখানোর এবং বেপরোয়া হয়ে উঠার সেটাও একটি কারণ। এটা জেনে আনন্দিত যে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উক্ত ছাত্র ও তার বাবাকে আটক করেছে। খতিয়ে দেখা দরকার এর পিছনে কারও ইন্ধন ছিল কিনা? এ ঘটনার সঠিক তদন্তপূর্বক সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করছি।

দ্বিতীয় যে ঘটনাটি সেটি পুরো শিক্ষক সমাজকে অপমানিত করেছে। একজন শিক্ষকের সারাজীবনে অর্জিত সম্মান ভূলুণ্ঠিত করেছে। সেটি হলো নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে অপদস্থ করার ঘটনা। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি সাজানো ও পূর্বপরিকল্পিত মনে হয়। দেশব্যাপী একটি চক্র এ সুযোগটি বারবার নিচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। একই কলেজের এক শিক্ষকও এ ঘটনার মদদদাতা হিসাবে নাম আসছে। পেশাগত দ্বন্দ্ব হয়তো এখানে কাজ করে থাকতে পারে। তবে এখানে আরও কিছু বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি। যে ছাত্রের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে এ ঘটনা, শুরুতে কারা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে পুলিশকে বাধা দিয়েছে, কারা এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষকে জড়ো করেছে, কারাই বা জুতা সংগ্রহ করে মালা তৈরি করেছে। ফেসবুক ফুটেজে কিছু আলামত রয়েছে যার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে দোষীদের আটক করে রিমান্ডের মাধ্যমে ঘটনার পিছনের ঘটনা বের করা প্রয়োজন। এধরণের ঘটনার সুষ্ট বিচার না হলে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাটির প্রতি মানুষ আগ্রহ হারাবে।

উক্ত শিক্ষক ৩০ বছর ধরে ঐ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। উনার মতে ছাত্রছাত্রী ও এলাকাবাসী উনাকে পছন্দ করতেন। তারপরও শতশত পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয়রা পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। পুলিশ ভ্যানের কাছে নেয়ার সময় পিছন থেকে অনেকে আঘাত করেন এবং মাটিতে পড়ে যান ও পিছন থেকে কেউ উনাকে মাথায় আঘাত করছিলেন। এতেই বুঝা যায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে ও উদ্ভূত প্রেক্ষাপটের ফায়দা নেওয়া হয়েছে। একজন মানুষের উপর এত দুঃখজনক একটি ঘটনার পরও উনি শান্তিতে নেই। ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে তিনবার ঠিকানা বদল করেছেন তিনি। এরই মধ্যে কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেটা বেরিয়ে আসছে তা হলো, মাস খানেক আগে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগের চেষ্টা চালায় কলেজের প্রভাবশালী একটি চক্র। এতে বাধা দেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদধারী উক্ত শিক্ষক। এরপর থেকেই চক্রটির তোপের মুখে ছিলেন তিনি। প্রশাসনের এ দিকটি খতিয়ে দেখা দরকার।

একটি দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো গঠনে ও সমাজে আলোকিত মানুষ গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। একজন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো যোগ্য নাগরিক। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে, অরাজনৈতিক ও অপসংস্কৃতি চর্চা বন্ধের নৈতিক শিক্ষা দিতে গিয়ে কখনো উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা কখনো বিক্ষুব্ধ ছাত্র দ্বারা আক্রান্ত-অপমানিত হচ্ছেন। নিজ ছাত্রছাত্রীদের হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। একসময় শিক্ষকদেরকে দেশ ও জাতি গড়ার কারিগর বলে যে সম্মান করা হতো বর্তমানে তা শুধু কাগজে-কলমেই আছে এবং বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও তাদের জীবনমানের উন্নয়নের বিষয়ে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। যেকোনো মানহানিকর কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করাও দরকার বলে মনে হয় সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে। তা না হলে ভালো ছাত্ররা এ পেশার প্রতি অনীহা দেখাবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পড়বে গভীর সংকটে।

লেখক: প্রফেসর, বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষক আপনের চেয়েও আপন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে