লাল পাহাড়

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ফারহানের মামার বাড়ির অদূরে বিশাল এক পাহাড়। নাম দেয়াঙ। কেউ কেউ বলে লাল পাহাড়। অনেক উঁচু পাহাড়। যেন আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে! মামার বাড়ির উঠান থেকে তাকালে মনে হয়, এইতো খুব কাছেই। সামনের ছোট্ট বিলটা পেরুলেই অনিন্দ্য সুন্দর টুকটুকে লাল পাহাড়।
ফারহানের বহুদিনের ইচ্ছে, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নীল আকাশটা একবার ছুঁয়ে দেখবে। আর ইচ্ছে মতো দৌঁড়াবে পাহাড়ের এই চূড়া থেকে ওই চূড়ায়……। কিন্তু বকুল মামার কারণে ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেল। যখনই সে পাহাড়ে যাবার কথা বলে মামার সেই এক কথা- ‘তুই এখনো ছোট। পাহাড়ে উঠতে পারবি না। আরও বড় হও, তারপর নিয়ে যাব একদিন।’
‘আর কত বড় হবো, মামা? আমি এখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। তুমি দেখে নিও, আমি ঠিক পাহাড়ের চূড়ায় হনহন করে উঠে যাবো সবার আগে।’
ফারহানের কথা শুনে মামা শুধু মুচকি হাসে। মুখে কিছু বলে না। তার মানে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার সম্মতি নেই মামার। ফারহানের তখন খুব রাগ হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই পাহাড় দেখবে বলে বায়না ধরে আসছে। কিন্তু বকুল মামা ‘না’তেই রয়ে গেছে!
ফারহান এবার মনস্থির করে ফেলেছে, পাহাড় না দেখে শহরের বাসায় ফিরবে না। কাল সকালে চা-নাস্তা সেরে কাউকে কিছু না বলেই সে একা বেরিয়ে পড়বে। বেশি তো আর দূরে নয়, এক চোখের পথ। একদৌঁড়ে পাহাড়টা দেখে আবার ফিরে আসবে। কেউ টেরই পাবে না।
ফারহানের মামা বাড়ির সামনে দিয়েই বয়ে গেছে পিএবি মহাসড়ক। সড়কের পশ্চিম পাশে লাগোয়া বিস্তৃর্ণ বিল। এর মাঝখান দিয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে একটা সরু মেঠোপথ চলে গেছে সেই দেয়াঙ পাহাড়ের দিকে। ফারহান সেই পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে অনেকক্ষণ, কিন্তু পথ আর ফুরায় না। যতই সামনে এগোয় পাহাড়টা যেন ততই পেছনে সরে যাচ্ছে!
ফারহান একবার পেছন ফিরে তাকালো। মামার বাড়ির পুকুর পাড়ে এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। তারমানে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত কাণ্ড! এতটা পথ পাড়ি দেয়ার পরও পাহাড়টা সেই দূরেই রয়ে গেছে। মামার বাড়ির উঠোন থেকে পাহাড়টা যেখানটাই দেখেছিল, এখনো ঠিক সেখানটাই রয়ে গেছে। পাহাড়ে পৌঁছাতে আরও যে কতদূর হাঁটতে হবে কে জানে।
ফরহান দ্রুত পা চালিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে। যত কষ্টই হোক, পাহাড়ে সে যাবেই। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর এসে ঠেকেছে। ফারহানের লম্বা ছায়াটা ছোট হয়ে পায়ে পায়ে লাগছে। কপাল, পিঠ বেয়ে বইছে ঘাম। ফারহানের ছোট্ট শরীরে এতটা ঘাম আগে কখনো ঝরেনি। আর এতটা পথও হাঁটা হয়নি। তবু এতটুকু ক্লান্তি নেই। কষ্ট নেই। পাহাড় দেখার আনন্দে বিভোর হয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে।
ভর দুপুর। কোথাও কেউ নেই। দেয়াঙের চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ। যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়। লাল রঙের অদ্ভুত পাহাড়টা কোথাও খাড়া, কোথাও ঢালু। আবার কোথাও সিঁড়ির মত থরথরিয়ে উঠে গেছে আকাশ পানে।
ছোট্ট ফারহানের সাহস আছে বটে। পায়ে পায়ে একা উঠে যায় ঠিক পাহাড়ের চূড়ায়। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর-পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, দূরের রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি।
মুগ্ধ নয়নে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে ফারহান। বাহ, অপূর্ব! যেন শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা কোন এক মনোরম ক্যানভাস। যতই দেখছে পুলকিত মন-প্রাণ আনন্দে নেচে নেচে ওঠছে।
হঠাৎ ‘হি হি’ হাসির শব্দে চমকে ওঠে ফারহান। এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। আবারও হি হি করে হাসির শব্দ কানে আসে। ফারহান আবারও এদিক ওদিক তাকায়। কেউ নেই! পুরো পাহাড় সুনসান। এবার ভয়ে ফারহানের গা শিরশির করে ওঠে।
‘কে? কে এভাবে হাসছো?’ বলতে বলতে গাছের একটা ডাল ভেঙে নেয় ফারহান। আবারও একই সুরে হাসির শব্দ।
‘এই তো, আমরা এখানে। তোমার ঠিক মাথার উপর।’
ফারহান উপরের দিকে তাকাতেই নজরে আসে দুটি শালিক পাখি। ভারি মিষ্টি। গাছের ছোট্ট একটি ডালে পাশাপাশি বসে হাসছে। ফারহান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পাখিগুলোর দিকে।
‘কি মতলব? কি চাই? কেন এসেছো এখানে?’ শালিক দুটোর কথায় আরেকবার চমকে ওঠে ফারহান।
‘কি হলো, জবাব দিচ্ছো না কেন? কেন এসেছো এখানে?’
‘পাহাড় দেখতে।’ ফারহান জবাব দেয়।
‘পাহাড় দেখতে এসেছো, না অন্য মতলব?’
‘অন্য মতলব! কেন?’ ফারহানের জবাব শুনে পাখি দুটো আবারও হাসে। বললো, ‘তোমরা মানুষরা বড়ই মতলববাজ! বড়ই নিষ্ঠুর! নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও ছাড়ো না।’
‘এসব কেন বলছো? মানুষ তোমাদের কী এমন ক্ষতি করলো?’
‘শুধু কী আমাদের? তোমরা মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করতেও ছাড়ো না!’ শালিক পাখি দুটির একটি একথা বলতে না বলতেই অন্য পাখিটি বললো, ‘তোমাদের কারণে এই সুন্দর পৃথিবীটা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। তোমরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও তোমাদের হাতেই ধ্বংস হতে চলেছে এই সৃষ্টি জগৎ।’
পাখিগুলোর চটাং চটাং কথা শুনে ফারহান আর রাগ সামলাতে পারলো না। রেগে মেগে বললো, ‘চুপ করো। মানুষকে নিয়ে এমন বাজে কথা বলো না।’
‘কোনটা বাজে কথা বলছো? তোমরা মানুষরা কী না করছো! পাহাড় ধ্বংস করছো, বৃক্ষ নিধন করছো, ফসলি জমি, খাল-বিল, নদী-নালা একে একে সব ভরাট করে অট্টালিকা বানাচ্ছো, যত্রতত্র মিল, কল-কারখানা বসিয়ে পরিবেশ দূষণ করছো! কিন্তু একবারও ভাবছো না, তোমাদের এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবী ভারসাম্য হারাতে বসেছে। আমরা পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, জীবজন্তু হারাতে বসেছি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। শুধু কী তাই, পৃথিবী ভয়ানকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার কারণে ঘনঘন ভূমিকম্প, ঝড়-তুফান, বন্যা, খড়াসহ আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। সুতরাং এখনই সতর্ক না হলে পৃথিবী দিন দিন আরও ভয়নক হয়ে ওঠবে!
‘এসব কী বলছো তোমরা?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো ফারহান।
এবার শালিক দুটি গাছটার নিচের একটি ডালে এসে বসলো। তারপর বলল, ‘শুনো মানুষ। তুমি এখনো অনেক ছোট। তাই এসবের কিছুই জানো না, বুঝো না। কিন্তু তুমি যে পাহাড়টাই দাঁড়িয়ে আছো, এমন উঁচু নীচুু আরও অসংখ্য পাহাড় ছিল এখানে। পাহাড়জুড়ে ছিল ছায়া শোভাসিত সবুজ বৃক্ষরাজী। তাতে ফুলে-ফলে আচ্ছাদিত থাকতো বছরের পর বছর। আমরা পশু-পাখি, জীবজন্তুরা নিরাপদে মনের আনন্দে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। আর ওইসব ফুল-ফল খেয়ে খিদা নিবারণ করতাম। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে এক এক করে অনেকগুলো পাহাড় সাবাড় হয়ে গেছে। হয়তো কিছুদিন পর এই পাহাড়টাও আর থাকবে না! তখন আমরা কোথায় যাব? কি খাবো? একবার চিন্তা করে দেখে।’ বলতে বলতে শালিক পাখি দুটো কেঁদে ফেললো। তাই দেখে ফারহানের ভেতরটাও কেঁদে ওঠলো হো হো করে।
সত্যিই তো, আমরা মানুষরা কত নিষ্ঠুর! সৃষ্টিকর্তা কত যত্ন করে এই পৃথিবীটাকে সাজিয়েছেন। কোথাও নদী, কোথাও পাহাড়, কোথাও সমতল। যেখানে যেটা না হলে নয়। অথচ এই অপরূপ সুন্দর পৃথিবীটাকে আমরাই ধ্বংস করে দিচ্ছি তিলে তিলে!
বয়সে ছোট হলেই বিষয়টা বুঝতে দেরি হয়নি ফারহানের। সৃষ্টি জগতের কোনো কিছুই অহেতুক নয়। পাহাড়, নদী-সাগর, বৃক্ষ, তৃণলতা, পশু-পাখি, জীব-জন্তু সবই প্রয়োজনের তরে সৃষ্টি হয়েছে। সবই এই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার নিয়ামক। তাই সৃষ্টিজগতের কোন একটা কিছু ধ্বংস করা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে প্রকৃতিকে নিয়েই বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে পরিবেশকেও।
ফারহান লাল পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে নি:শ্বাস নিতে নিতে ভাবে, মানুষ কেন বুঝেও বুঝে না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানেই নিজেকে ধ্বংস করা। মানুষ সৃষ্টির সেরাজীব হয়েও কিভাবে নিজেরা নিজেদের এমন সর্বনাশ করতে পারে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধভেদাভেদ ভুলে ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে
পরবর্তী নিবন্ধমা