যে কথাটি ‘মা’ কে হয়নি বলা

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

‘Things I could never tell my Mother’ নামক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে নিজের গল্প বলেছেন নির্মাতা হুমায়রা বিলকিস। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৌরে জীবনধারাকে তুলে আনেন তিনি তাঁর ছোট্ট একটি ক্যামেরা আর মুঠোফোনে। পোশাক আর সাজসজ্জায় বিন্দুমাত্র অর্থ ব্যয় না করে, প্রাকৃতিক আলোর ওপর ভর করে চিত্রনাট্যবিহীন এই চলচ্চিত্র এগিয়ে যায় আপন গতিতে। শুরুতে দিগন্তজোড়া শর্ষেক্ষেত দেখিয়ে গল্প শোনানোর একটা চমৎকার আবহ তৈরি করেন তিনি। কিন্তু পরের দৃশ্যগুলোতে যেন নির্মাতার হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বাবামায়ের কথোপকথন, মায়ের একান্ত ঘরকন্যা, মেয়ের জন্য দীর্ঘশ্বাস, মায়ের কোরআন শিক্ষিকার আগমননির্গমন, বাবার অসুস্থতা, মায়ের অসহায়ত্ব কোনো কিছুতেই পরিচালকের হাত ছিল না। সম্ভবত তাঁদের না জানিয়েই তিনি দৃশ্য ধারণ করেছিলেন, যে কারণে কোথাও কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। পরিচালক মাঝে মাঝে ক্যামেরার পেছন থেকে সামনে আসেন এবং পারিবারিক দৃশ্যাবলীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। মায়ের সঙ্গে রান্নায় হাত লাগান, এক টেবিলে বসে চা খেতে খেতে গল্প করেন। তাঁদের টুকরোটুকরো গল্প ছুঁয়ে যায় দর্শকের মন। নিজের জীবনের সঙ্গে কোনো না কোনো মিল খুঁজে পায় তারা। মনে হয়, আমার মাকে নিয়েওতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়, উপন্যাস রচনা করা যায়। এখানেই ‘Things I could never tell my Mother’ হয়ে ওঠে আমারআপনার সকলের গল্প।

পরিচালক যখন ভাইয়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় মায়ের কথা বলে, আক্ষরিক অর্থেই মায়ের নামে ভাইয়ের কাছে অভিযোগ করে তখন মনে হয়কি আশ্চর্য! আমিওতো ঠিক এমনি করে প্রবাসী ভাই বোনদের সঙ্গে বাবামাকে নিয়ে কথা বলি। এই অভিযোগের অর্থ কিছুতেই তাঁদের বিচার বা শাস্তি চাওয়া নয়, বরং ভাই বোনের কাছ থেকে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করা। সব ঘরে ঘরেই চলে এই গল্প। এই মতপার্থক্য নিয়েই এগিয়ে যায় জগত সংসার। তীব্র ভালোবাসার গভীর বন্ধনে বাঁধা পড়া মানুষগুলোর মনোজাগতিক টানাপোড়েনই দিনশেষে তাদেরকে আরও কাছাকছি নিয়ে আসে, নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেয় পরস্পরের প্রতি।

চলচ্চিত্রের এক পর্যায়ে মামাতো বোনের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপচারিতার সময় পর্দায় ভেসে ওঠা শর্ষে ক্ষেত দেখে মনে হলো গল্পের শেষ দৃশ্যটা হয়তো শর্ষে ক্ষেতেই চিত্রিত হবে। সাধারণ দর্শক ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ শেষ দৃশ্যে এমন কিছুই দেখতে চায়। শর্ষে ক্ষেতের সঙ্গে শান্তি আর মিলনের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পেতে চায় তারা। কিন্তু ডকুমেন্টরি বলেই হয়তো তা হলো না।

চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীনচেতা মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হয়নি। তার আগেই ভালোবাসার সেই যুবক হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে। ক্ষুদে বার্তায় জানিয়ে দেয় আর অপেক্ষা করা চলে না। কে জানে হয়তো তারও যুদ্ধ চলছিল মায়ের সঙ্গে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

নিখাদ সততার সঙ্গে তার জীবনের গল্প চিত্রিত করেন পরিচালক হুমায়রা বিলকিস। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মায়ের নাম। প্রচলিত ধারায় বাবার পদবি নয়, মায়ের নামের পদবি সাক্ষ্য দেয় তার মায়ের স্বাধীন সত্তা। মা খালেদা বিলকিসের লালচে কবিতার খাতার সঙ্গে সাদাকালো আর রঙিন ছবির এ্যালবামগুলো মেয়েকে শক্তি যোগায়। এমন মায়ের মেয়েরইতো ভিন্ন পথে হাঁটার কথা, সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠার কথা। সেই ভিন্ন পথ কখনোই ঐতিহ্য আর স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। মায়ের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পরিচালক মায়ের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তাঁর স্বপ্নের পথে হেঁটে চলা দেখিয়েছেন।

সৃষ্টিশীল মানুষদের মাঝে ‘বিদ্রোহী’ সত্তা সতত দৃশ্যমান। এ বিদ্রোহ প্রায়শই আপনজনদের বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরুদ্ধেও। গতানুগতিক সনাতনী সমাজব্যবস্থায় ‘ভিন্নধর্মী’ কাজকে সহজ চোখে দেখা হয় না। প্রতিবন্ধকতা আসে নানা দিক থেকে নানান মাত্রায়। আর্থসামাজিক বাধা, ধর্মীয় বাধা ছাড়াও পারিবারিক মনস্তত্ত্ব বা মূল্যবোধ এক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রজন্মের এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন এবং এই বিরোধ কেবল বাঙালি মুসলমান পরিবারে নয়, প্রাচ্য প্রতীচ্যের সকল সমাজেই বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের সমাজে অভিযোগের তীরটা চিরকাল বাঙালি মুসলমানের দিকেই তাক করা থাকে এবং নারী হলে তো কথাই সেই। আধুনিকতা ও প্রগতির বিচারে বাঙালি মুসলমানকে এক অপাংক্তেয় সমপ্রদায়ের তালিকায় ফেলে দেওয়ার একটা মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়।

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে অনেকেই ইসলামকে কঠিন আর জটিলভাবে উপস্থাপন করে নানামুখী বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছেন, যার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় হুমায়রা বিলকিসের মা সহ আরও অনেক নারীর আচরণে, যারা জীবনের মধ্য গগনে এসে নব্য ধর্মান্তরিতের মতো হঠাৎ করেই শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরিধান করেন। কারণ তাঁরা মনে করেন শাড়িতে ইসলাম রক্ষা হয়না। আজকাল কিশোরী, তরুণীরাও এই ভাবনায় আচ্ছন্ন আর আচ্ছাদিত হয়ে দলে দলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। পোশাক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মনোজগতে ঝড় ওঠে, এবং নিজের অজান্তেই তাঁরা সহজ সরল একটা জীবনকে ধর্মের নামে ক্রমাগত জটিল করে তোলেন। এই জটিলতার মাশুল গুনতে হয় পরিবারপরিজন, সন্তান, এমনকি জীবনসঙ্গীকেও। পরিণামে একেক জন হয়ে ওঠেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। ধর্ম নিয়ে এই বাড়াবাড়ির অবসান হওয়া একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি।

মায়ের মনোজাগতিক বিপ্লব এবং তাকে কেন্দ্র করে মামেয়ের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ‘Things I could never tell my Mother’প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি সমাজে ভাবনার খোরাক যোগায়। এই ভাবনার মাত্রা ও আঙ্গিক নানামুখী। বলাবাহুল্য, প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবনদর্শনের আলোকেই এই চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে আলোচনা করবেন, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন, গবেষণা করবেন। আশা করি, যে যার অভিমত উপস্থাপন করবেন ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই। সমাজের স্বার্থেই এই আলোচনা, বিতর্ক ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন।

. সালমা বিনতে শফিক, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগরী পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধফেরোমোন হরমোন