মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী রাইফেল ক্লাব অপারেশন

সাথী দাশ | সোমবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

এই বিষয় নিয়ে ইতোপূর্বে দু’একটি পত্রিকায় ও প্রকাশিত গ্রন্থে কয়েকটি লেখা চোখে পড়েছে। কিন্তু অলস সময়ের ভাসমান প্রবৃত্তিতে আবদ্ধ থাকার কারণে কিংবা লেখকদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত উদারতার কারণেই হয়তো দীর্ঘদিন চুপচাপ ছিলাম। ইদানীংকালে কিছু কিছু বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা (গল্প) পড়ে মনে হলো, নিজেকে জাহির করার জন্য বর্তমান সমাজবাস্তবতায় এটাই মোক্ষম পথ। তবে সারি সারি নামের সারিতে যে নামগুলো আসে, তারা যুদ্ধকালীন সময়ে কোথায় ছিলেন (?) এ প্রশ্নটা সামনে আসলে লেখকের মুখে জবাবটা পাওয়া যাবে আদৌ? সে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় একজন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধার দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিচ্ছিন্নতার কারণে নামটা চাপা পড়ে যাক এটা কোনমতেই কাম্য নয়। এই বিবেচনাটা সামনে রেখেই নীতিবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এই অপারেশনের সত্য ইতিহাসটা তুলে ধরছি।

দুই.
২৫শে মার্চ ভোর সকাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগর ছিলো মিছিলের শহর। চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর, ৩নং জেটি এলাকাসহ বন্দরের পূর্বে-পশ্চিমে সবদিকেই মিছিল এবং প্রতিরোধ – বিক্ষোভ। এদিকে শহরের স্টেশন রোড, জুবিলী রোড, স্টেডিয়াম রোড, পাঁচলাইশ-মেডিকেল রোড, সিরাজউদ্দৌলা রোড-আন্দরকিল্লা-চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-লালদীঘির মাঠ এলাকাসমূহে ছাত্র-শ্রমিক ও স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনতার মিছিলে-শ্লোগানে সমুদ্রের উত্তাল গর্জন। এক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রিত (জেলা ছাত্রলীগ) মিছিল শেষ করে (লালদীঘির মাঠে তখনও চলছে শহর ছাত্রলীগ-শ্রমিক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগঠনের সভা) হাজারী গলির মোড়ে এসে সবায় জড়ো হয়। ছাত্রনেতারা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেন। আমরা অনেকেই এখানে উপস্থিত ছিলাম কিন্তু নির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট মানুষের নাম এখানে উচ্চারণ করেছি। রুশ্নিভাই (শওকত হাফিজ খান রুশ্নি), রাজুভাই (আবদুল্লাহ আল রায়হান), নিজামভাই (এ.বি.এম নিজামুল হক), সাবেরভাই (সাবের আহমদ আসগরি), হাসেমভাই (আবুল হাসেম) সহ আরো কয়েকজন ছিলাম। টুকটাক কথাবার্তা বলে হাসেমভাই, সাবেরভাই ও নিজামভাই ছাত্রলীগ (অফিসের বিনোদা ভবন) অফিসের দিকে চলে গেলেন। এরমধ্যে রাজুভাই রুশ্নিভাইকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা বলছেন। কথা বলা শেষ করে রুশ্নিভাই সামনে এসে আমার (অরুণ দাশ) দিকে তাকিয়ে ‘সন্ধ্যার দিকে চলে আসবে, আমি বাসায় যাচ্ছি’ বলে টেরিবাজারের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাজু ভাই পথ চলতি রিক্সা ডেকে আমাকে বললেন, ‘ওঠ রিক্সায়’। রিক্সায় যাওয়া মানে আমাদের গন্তব্য একদিকে। রাজুভাই সিরাজউদ্দৌল্লা রোডের ঈশ্বরনন্দী লেইনে, আমি রুমঘাটার গল্লি। রিক্সা চলতে শুরু করলে রাজুভাই এক সময় বলে উঠলেন – সন্ধ্যায় চলে আসবে অফিসে। রুশ্নিকে আর নিজামকে বলেছি।’ আমি কিছু বলতে গেলে হাত তুলে রাজুভাই বলে উঠলেন, ‘নো প্রশ্ন। সন্ধ্যায় দেখা হলে বলবো। তবে আমরা একটা কাজে যাবো – এটা মনে রাখবে।’ রিক্সা রুমঘাটার মুখে এসে গেলে আমি রাজুভাইকে বলে নেমে গেলাম।

তিন.
সন্ধ্যা ৭টার দিকেই আমি ও রুশ্নি ভাই এসেছিলাম। কিন্তু হাজারী গলির মুখে কালামভাইয়ের (আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ) সাথে দেখা হওয়াতে তিনি আমাদের দু’জনকে ১২০ আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে যান। সেখানে বর্তমান পরিস্থিতির বিভিন্ন খবরাখবর শুনতে শুনতে আমাদের ঘন্টা দেড়েক সময় কেটে যায়। এরপর আমরা দু’জন ছাত্রলীগ অফিসে এসে দেখি, নিজামভাই অফিস নেই। এর মধ্যে সাবেরভাই বলে ওঠে, ‘রুশ্নি, তোমাদের দু’জনকে তো রাজু কয়েকবার খুঁজেছে। কোথায় নাকি যাবার কথা ?’ তখনই মনে পড়লো দু’জনের রাজুভাইয়ের কথা। সে যা হোক এখন অফিসের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ছাত্রনেতৃবৃন্দের কথা শুনছি। হালিশহর, ঝাউতলা, কাট্টলিসহ বিহারী গোষ্ঠী বসবাসকারী এলাকা সমূহে অঘোষিত যুদ্ধের প্রস্তুতি ও বাঙালিদের হত্যা করার সংবাদ ওরা (বিভিন্নজন) বলে যাচ্ছে। সবার মনে এক ধরনের শঙ্কা ও ভয় আপনাতেই ঘিরে ধরছে। রাতও বাড়ছে। এর মধ্যে নিজামভাই এসে বসলো চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর আমরা কয়েকজন নীচে নেমে এলাম চা খেতে শাম্মি হোটেলে।

চার.
সেদিনকার (২৫ মার্চ ’৭১ সাল) ঘটনা (রাইফেল ক্লাব অপারেশন) বর্ণনা করতে গিয়ে আবদুল্লাহ আল রায়হান রাজু যা বলেন, তার মূল বক্তব্য হলো :…সেদিন আমাদের (শওকত হাফিজ খান রুশ্নি ও অরুণ দাশ) না পেয়ে রাজুভাই (আবদুল্লাহ আল রায়হান) নিজামভাইকে নিয়ে রাইফেল ক্লাবে চলে যান। রাজুভাইয়ের সাথে ছিল আলম নামের এক রিক্সাওয়ালা ও কাসেম নামে এক রাজমিস্ত্রি। দু’জনই ছিল রাজুভাইয়ের বিশ্বস্ত লোক। রাজুভাই চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ছাত্রনেতা। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ও জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন। তিনি রাইফেল ক্লাব অপারেশন এর মূল পরিকল্পনাকারী ও অন্যতম বাস্তবায়নকারী। সাথে ছিলেন এবিএম নিজামুল হক কাসেম রাজমিস্ত্রি ও রিক্সাওয়ালা আলম।

এ পরিকল্পনা রাজুভাই দু’দিন ধরে করে আসছিলেন। তাঁর মামা ছিলেন (মোফাচ্ছেল আহমদ চৌধুরী রাউজান ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা) রাইফেল ক্লাবের সেক্রেটারী। উনাকে কোন মতেই রাজি করাতে পারছিলেন না। শেষমেশ শহর ও দেশের অবস্থার পরিবর্তনে মামা এক সময় রাজি হন। উনি রাজুভাইকে বলেছিলেন, বাইরের গেইটের চাবি দারোয়ানের কাছে আছে কিন্তু ভেতরের অস্ত্রের বোল্ড রুমের চাবি দেওয়া যাবে না। তাই তিনিই বলে দিয়েছিলেন, ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে এক মিস্ত্রি যেন সাথে যায়। নন্দনকানন মোড় বা শহীদ মিনারের পশ্চিম দিকে একটা বাংলা টাইপের ঘর। রাস্তার পাশে গেইট থেকে ছোট আকারে পাকা করা ক্লাবের সিঁড়ি পর্যন্ত। পথের দু’পাশে সবুজ ঘাসে-ঢাকা খালি জায়গা। আলম রিক্সা নিয়ে কাসেমসহ ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির ডান পাশের কোনায় রিক্সাটা দাঁড় করায়।

এরমধ্যে রাজুভাই নিজামভাইকে নিয়ে রাস্তায় রিক্সা ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকে ওরা। দারোয়ান এগিয়ে এসে প্রশ্ন করতে চাইলে চারজন তাকে ধরে বোঝায় সেক্রেটারী বলেছেন, সামনের গেইট খুলে দিতে। সে বাড়াবাড়ি আপত্তি করলে, কাসেম ও আলম মুখ চেপে ধরে পকেট থেকে চাবির গোছা বের করতে চাইলে দারোয়ান শেষমেশ চাবি দিয়ে তালাটা খুলে দেয়। দরোজা খুলে দারোয়ানসহ ভেতরে প্রবেশ করে পাঁচজন। দারোয়ানকে সামাল দিয়ে আলম ভেতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়। কাসেম ইতোমধ্যে ছেনি-হাতুড়ির কাজ শুরু করে দেয়। পাকা দেওয়াল, তার মধ্যে শক্ত লোহার দরোজা, কষ্ট আর শব্দ তো হবেই। মাঝে মাঝে কোড়াবাড়ি দিয়ে দরোজার হুকে টান, গুতো দিচ্ছে। এভাবে হুকের পাশের দেওয়ালের অংশ (ইট-সিমেন্টের গাঁথুনি) গুড়িয়ে দিতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। হুক দু’টা খোলা হয়েছে, আরো দু’টা খোলার বাকি আছে। এরমধ্যে নিজামভাই অফিসের দিকে চলে আসতে চাইলে রাজুভাই তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে।

এরপর খুব দ্রুত হুক খোলার কাজে কাসেম তৎপর হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পর নিজামভাই অফিসের ফোনের কথা, বর্তমান সময়ের কথা বুঝিয়ে ছাত্রলীগ অফিসে চলে আসে।…এদিকে রাজুভাই বোল্ডের লোহার দরোজা খোলার পর তাঁর মামার কথামতো পিস্তলের বাক্সগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে। এরপর খুঁজতে থাকে গুলির বাক্স। তাও পাওয়া গেল। বাক্সগুলোর গায়ে লেখা ছিলো গুলির বিবরণ। এগুলো বাইরে বের করে আনে কাসেম। বিভিন্ন ধরনের রাইফেল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গুলির বাক্সের গায়ে কিছু লেখা বা চিহ্ন নেই। তাই ঐগুলো বাদ দিয়ে শুধু দু’টা পিস্তল-রিভলভারের গুলিসহ বক্স নিয়ে বোল্ডের এর দরোজাটা টেনে দিয়ে দরোজা খুলে বের হয়ে আসে চারজন। দারোয়ানকে বাইরের গেইটটা লাগিয়ে দিতে বললে, সে তাই করে। কাসেম-আলম একটা একটা করে বাক্স ২টা রাস্তার কাছে গেইটের পাশের অন্ধকারে দিকে এনে রাখে। রাজুভাই রাস্তায় বের হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ একটা জীপ নিউমার্কেটের দিক থেকে আসতে দেখে রাজুভাই সামনে গিয়ে জীপের সামনে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়। জীপে শুধু ড্রাইভার। জীপটা পোর্ট ট্রাস্টের। ড্রাইভারকে আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে যেতে বললে সে যাবো না বলা মাত্রই পেছন থেকে কাসেম ও আলম দু’জন এসে ড্রাইভারকে নীচে নামিয়ে আনে। ড্রাইভার পরে যাবে বললে, ওরা দু’জন এক এক করে বাক্স ২টা গাড়ির পেছনে তোলে। রাজুভাই ড্রাইভারের পাশে বসে। কাসেম-আলমকে বলে, ‘তোরা রিক্সা নিয়ে চলে যা, কাল সকালে বাসায় চলে আসবি।’

এর মধ্যে রাত সাড়ে নয়টা। রাজুভাই জীপ নিয়ে আন্দরকিল্লা-হাজারী লেইনের মুখে চেনা কাউকে না দেখে রাজুভাই সরাসরি তাঁর দুলাভাই ওয়াপদার প্রকৌশলী সামশুল হক সাহেবের বাসায় (জামাল খান) গিয়ে বাক্স ২টা নামিয়ে রাখেন। রাজুভাই ড্রাইভারকে ঐদিন কিছু টাকা দিয়ে খুশি করে দিলেন। পরবর্তীতে বাক্স খুলে এগারটা পিস্তল পেয়েছিলেন রাজুভাই। এর পরেরদিন, অর্থাৎ ২৬ মার্চ, রাজুভাই সকালে নিজামভাই, সাবেরভাই, হাসেমভাই, মন্টুভাই (চট্টগ্রাম কলেজের জিএস মনিরুজ্জামান মন্টু), কেন্দ্রীয় নেতা স্বপন চৌধুরী ও রুশ্নিভাইকে একটা করে গুলিভর্তি করে পিস্তল দিয়েছেন বলে সাক্ষাৎকারে বলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, একটা নাজমুল আলম সিদ্দিকীর শ্বশুর একজন ক্যাপ্টেনকে (নামটা মনে পড়ছে না) কে, একটা নিজের কাছে, একটা বড় ভাই আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুনকে, একটা দুলাভাইকে (শামসুল হক) দিয়েছিলাম আর একটা কাকে দিয়েছিলাম মনে পড়ছে না বলে উল্লেখ করেন। তবে রুশ্নিভাই সকালে তাঁর পিস্তলটা সেদিন বাসায় ঢোকার পর সামনের বামপাশের টিনের ঘরটার নীচে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রেখে প্রথমে ছাত্রলীগ অফিস এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজে চলে আসেন। রাজুভাই এর সাথে একবার আমাদের সাথে দেখা হয় চট্টগ্রাম কলেজে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এভাবেই ২৫ মার্চ রাত্রে রাইফেল ক্লাব অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিল যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতার এককোনায় হয়তো স্থান পেলেও পেতে পারে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্তন ক্যানসার থেকে মুক্তি ও স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি এর টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল