স্তন ক্যানসার থেকে মুক্তি ও স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি এর টুকিটাকি

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন | সোমবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

স্তন ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে এবং সঠিক চিকিৎসা পেলে শতভাগ ভাল হয়ে যায় এবং রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নিরুপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি। ম্যামোগ্রাম মেশিন হলো বিশেষ ধরনের একটি এক্স-রে মেশিন যার মাধ্যমে স্তন এর ছবি তোলা হয়। সেই ছবি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত রেডিওলজিস্ট(এক্স-রে এর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) পরীক্ষা করে বলতে পারেন স্তন এ কোনো টিউমার এর অস্তিত্ব আছে কিনা।
একটি ম্যামোগ্রাম মেশিনের দাম কোটি টাকার উপর হতে পারে। ম্যামোগ্রাম মেশিন দুই ধরনের হয়ে থাকে একটি সাধারণ এবং অন্যটি টমোসিনথেসিস অথবা৩-উ ম্যামোগ্রাম মেশিন। ৩-উ ম্যামোগ্রাম এ টিউমারের অস্তিত শনাক্ত করা বেশি সহজ হয়। ম্যামোগ্রাম ছাড়াও এমআরআই এর সাহায্যও টিউমার শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এমআরআইতে খরচ একটু বেশি হয়।

কখন এবং কাদের ম্যামোগ্রাম করা দরকার?

একজন মহিলার বয়স ৪৫ বৎসর হলে ম্যামোগ্রাম করানো জরুরি।

যদি পরিবারে মা/বোনের স্তন ক্যানসার আগে হয়ে থাকে তাহলে ৪০ বৎসর বয়স থেকে ম্যামোগ্রাম প্রতি বৎসর করতে হবে।

ম্যামোগ্রাম করানোর আগে আপনাকে নিম্নলিখিত তথ্যগুলো বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে-

১. আপনার নিকটস্থ হাসপাতাল / ক্লিনিক এ টমোসিনথেসিস মেশিন আছে কিনা জেনে নিন। ম্যামোগ্রাম টমোসিনথেসিস ডিজিটাল ৩-উ মেশিনে করাতে পারলে ভালো হয়। ২. ম্যামোগ্রাম করানোর সময় মহিলা টেকনিশিয়ান থাকাটা জরুরি। কারণ মহিলা টেকনেশিয়ান হলে মেয়েরা কমফোর্টেবল ফিল করে। ৩. যেই রেডিওলজিস্ট রিপোর্ট তৈরি করবেন উনি ম্যামোগ্রাম এ পর্যাপ্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত কিনা জেনে নিন। কারণ সব রেডিওলজিস্ট এর পক্ষে ম্যামোগ্রাম এর রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এই তথ্যটি হাসপাতাল / ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানতে পারবেন। ৪. সম্ভব হলে সমবয়সী কয়েকজন মিলে একসাথে (মনের জোর ভাল থাকবে) ম্যামোগ্রাম করাতে যেতে পারেন। পরীক্ষার আগের দিন ইউ টিউব এ ম্যামোগ্রাম এর ভিডিও দেখে নিন। ৫. সাধারণত ম্যামোগ্রাম এর ছবি ডিজিটাল হলে হাসপাতাল অথবা ক্লিনিক সংরক্ষণ করে থাকে। যদি সেই ব্যবস্থা না থাকে তাহলে আপনি ক্লিনিক কে বলতে পারেন আপনার ম্যামোগ্রাম এর ছবি একটি সিডিতে আপনাকে দিতে। পরবর্তী বৎসর আবার ম্যামোগ্রাম করলে যেন আগের ম্যামোগ্রাম এর সাথে তুলনা করতে পারে। ৬. ম্যামোগ্রাম এর রিপোর্ট ও ছবি দুটোই আপনার কাছে এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট এর মত যত্ন করে রাখবেন। ৭. ম্যামোগ্রাম নরমাল হলে প্রতিবৎসর একবার করে করতে হবে। ৮. যদি সন্দেহ জনক কিছু পাওয়া যায় তাহলে আপনাকে ডায়াগনস্টিক ম্যামোগ্রাম এবং আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হবে। ৯. এই ক্ষেত্রে এমন একজন রেডিওলজিস্ট এর কাছে যাবেন যিনি কোর বাইওপসি করতে পারদর্শী। এফএনএ বাইওপসি না করাই ভালো। কোর বাইওপসি তে সাধারণত একটু মোটা সুঁই ব্যবহার করা হয়, যাতে করে বেশি টিস্যু পাওয়া যায় এবং প্যাথলজিস্ট (বিষেশজ্ঞ ডাক্তার যিনি অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে টিস্যু দেখে রোগ নির্ণয় করেন) ক্যানসার শনাক্ত করা ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন ইস্ট্রোজেনরিসেপ্টর(ER), প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর (PR) ও nvi-2 (HER-2) এর উপস্তিতি জানাতে পারেন।

কারণ পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য অনকোলজিস্ট (ক্যানসার চিকিৎসক) এর এই তথ্যগুলো দরকার হবে। ১০. চট্টগ্রাম এ উপরোক্ত প্যাথলজী পরীক্ষাগুলো করা হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে এইক্ষেত্রে রোগী হিসাবে আগে থেকে জেনে নিবেন কোন ল্যাবরেটরীতে আপনার টিস্যু পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। বাইওপসি টিস্যু সাধারণত একটি নির্দিষ্ট কনসেনট্রেশন এর ফরমালিন এসংরক্ষণ করে ল্যাব এ পাঠাতে হয়। ১১. ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল )এর প্যাথলজী বিভাগ এই পরীক্ষায়গুলো অনেক কম টাকায় করে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে আগে ভাগে খোঁজ নিতে হবে কোথায়, কখন কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে এই বাইওপসি টিস্যু পিজি হাসপাতাল এর প্যাথলজীবিভাগে পৌঁছাতে হবে। ১২. চট্টগ্রাম এর ল্যাবগুলো কিভাবে টিস্যু স্যাম্পল ঢাকায় পাঠায় এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া আপনার দায়িত্ব এবং ল্যাবগুলো এই তথ্য আপনাকে দিতে বাধ্য। সম্ভব হলে নিজেদের লোকজনের মাধ্যমে ঢাকায় টিস্যু স্যাম্পল পাঠাবেন। কারণ এখানে টিস্যু কালেকশন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ এবং সময়ের একটা ব্যাপার আছে। টিস্যু যে কোনো কুরিয়ার এর মাধ্যমে পাঠানো ঠিক হবে না। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম এর ল্যাবগুলোর নিশ্চয় কোনো পলিসি আছে। ১৩. ম্যামোগ্রাম করার পর আপনার অভিজ্ঞতা সোস্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে পারেন। তাহলে অনেকেই উৎসাহিত হবেন।

হাসপাতাল অথবা ক্লিনিক এর সার্ভিস নিয়ে গুগুলরিভিউও লিখতে পারেন। যার ফলে হাসপাতাল / ক্লিনিক তাদের সেবার মান আরো উন্নত করবে (যদি সন্তোষজনক সেবা না পেয়ে থাকেন)। ১৪. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজের ম্যামোগ্রাম করার সময় আপনার বাসার সার্বক্ষণিক সাহায্যকারী মহিলাটির কথাও মনে রাখবেন। উনার বয়স যদি ৪০-৪৫ হয় উনাকে বৎসরে সদকায়ে জারিয়া হিসাবে একটি ম্যামোগ্রাম বোনাস দিন। ১৫. ভুলেও কখনো কোনো হোমিওপ্যাথ অথবা আয়ুর্বেদিক ওষুধ স্তন ক্যানসার ও কোনো ধরনের ক্যানসার এর জন্য ব্যবহার করবেন না। ১৬. সাধারণত স্তন ক্যানসার এর চিকিৎসা কয়েকজন ডাক্তার মিলে করে থাকেন। এটা একটা টিম এ্যাফোর্ট। ডাক্তারদের টিমে থাকেন রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, ব্রেস্ট সার্জন, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ও মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট।সুতরাং আর দেরি না করে আজই নিজের ম্যামোগ্রাম এর জন্য আপনার ডাক্তার এর সাথে কথা বলুন এবং নিজেকে স্তন ক্যানসার থেকে মুক্ত রাখুন। পুরুষেরও স্তন ক্যানসার হয়। আপনার স্তনও হাত দিয়ে পরীক্ষা করুন কোনো গোটা আছে কিনা দেখুন।

লেখক : রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, হ্যালিফ্যাক্স, কানাডা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশু বর্ষা হত্যাকারীর ফাঁসির দাবি
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী রাইফেল ক্লাব অপারেশন