মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসঞ্চারী বেগম মুশতারী শফী

আবুল কালাম বেলাল | শনিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

নারী জাতির অহংকার, চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশের গর্ব, মুক্তিযোদ্ধা সাহিত্যিক বেগম মুশতারী শফী। অনেক গুণে গুণবতী মহীয়সী নারী তিনি। তাঁর অনন্যসাধারণ রঙিন ও বর্ণাঢ্য জীবনের কীর্তিগাথা সমাজ, দেশ ও জাতির পথচলার পাথেয়। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করেছেন আমৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। তিনি দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। তবে অস্ত্র দিয়ে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, আশ্রয়, সাহসবুদ্ধি প্রভৃতি সহায়তা দিয়ে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায় এবং তিনি শহীদ হন। স্বামীকে হারিয়ে বেগম মুশতারী শফী ভেঙে পড়েননি। বরং ফিনিক্স পাখির মতো নব উদ্যোমে, নব শক্তিতে দৃঢ় অঙ্গীকারে পাকিস্তানি হানাদারের সর্বনাশ ডেকেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে। বেগম শফী দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অগাধ। তিনি বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায়, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সাধ্যমত ভূমিকা রেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোতে। তিনি কষ্ট, নির্যাতনকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় ধরে মানব মুক্তির জন্য জীবনবাজি লড়াই চালিয়েছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কলম হাতে বাঙালি জাতিকে শুনিয়েছেন অজস্র বীরত্বগাথা। তাঁর জীবনদর্শনই ছিল– ‘মানব প্রজন্মের ইতিবাচক (প্রগতিবাদী) ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজন জাতিগোষ্ঠীর মনোসামাজিক পরিবর্তন এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা। মুক্ত মন গ্রহণবর্জনের ধারাকে সচল রাখে। যা গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের সূচক।’ নারী জাগরণে প্রগতির পথে উজ্জীবিতকরণে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় ও অনুসরণীয়। তিনি বান্ধবী সংঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীদের একত্রিত করেছেন। এ সংঘকে কেন্দ্র করে নারীদের জন্য প্রকাশ করেছেন ‘মাসিক বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা। যার ছাপাখানা, প্রকাশ, প্রচার ও লেখালেখি সবই নারীদের দিয়েই করা হত। নারীদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন বেগম মুশতারী শফী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মহীয়সী সিদ্ধ হস্তেই পরিচালনা করেছেন সংসার, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সবক্ষেত্রেই তিনি সঞ্চার করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। প্রকৃতপক্ষে লেখনি, বক্তব্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গৌরবগাথা ও চেতনাকেই ফেরি করেছেন মানবসমাজে। আজীবন এই কাজই তিনি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন গল্প করেছেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যখন কলম ধরেছেন তখনও মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি রাজনৈতিক মঞ্চে, সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানমালায়, বইমেলাসহ যাবতীয় অনুষ্ঠানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অকাতরে বিলিয়েছেন। তুলে ধরেছেন অজর অমর মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, সম্ভ্রমহারা নারীদের আত্মনিবেদন। এমন একটি স্মৃতিকথা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। সবারই জানা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক চট্টগ্রাম একাডেমি ফিবছর আয়োজন করে আসছে স্বাধীনতার বইমেলা। সপ্তদশ স্বাধীনতার বইমেলা ২০১৬ এর চতুর্থ দিনে (২৫ মার্চ ২০১৬) লেখক সম্মিলনে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে লেখার বিষয় ও লেখকদের পথনিদের্শনা দেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের স্বাধীনতাকে মনে রাখতে হবে। স্বাধীনতার ইতিহাসকে ভুললে চলবে না। ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আমাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে। সেই দিনগুলোর সঠিক ইতিহাস শিশুকিশোরদের খেলার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে, ছড়াকবিতা ও লেখাপড়ার মাধ্যমে জানাতে হবে, শেখাতে হবে।’’

এই বক্তব্যই প্রমাণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে মানুষের কাছে ফেরি করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, একটি প্রকাশনা উৎসবে কবিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি পবিত্র কোরআনের একটি সুরা তুলে ধরে বলেন, কবিতার জন্য শব্দ, ছন্দ, উপমার প্রয়োজন। বিশেষ করে ছোটোদের জন্য লিখিত কবিতায় থাকতে হয় এসব। তার সাথে থাকে অন্ত্যমিল। অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা অন্ত্যমিলহীন কবিতার তুলনায় বেশ হৃদয়স্পর্শী এবং সহজে পাঠমুগ্ধ হওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে সুরা এখলাস নামে একটি সুরা আছে। যেমন– ‘কুলহু আল্লাহু আহাদ/ আল্লাহুস সামাদ/ লাম ইয়ালিদ/ওয়ালাম ইউলাদ/ ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।’ এ সুরার অন্ত্যমিল হাদ/ মাদ/ লাদ/ হাদ। এ ধরনের সুরা অতি সহজেই মুখস্ত হয়ে যায় এবং অল্প সময়ে হৃদয়ঙ্গম হয়। তেমনি অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতাও পড়তে মজা। ছোটদের জন্য অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লেখার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘‘এসব অন্ত্যমিলের কবিতায় অবশ্যই আমাদের মহান ভাষা, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন শেখ মুজিবের কীর্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা, বিজয় দিবস ইত্যাদি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।’’ এভাবেই বেগম মুশতারী শফী আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রজন্ম পরম্পরায় তুলে ধরেছেন।

২০২১ সালে ২০ ডিসেম্বর এ মহীয়সী আমাদের ছেড়ে চলে যান। জীবদ্দশায় তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসংস্থা থেকে প্রায় ৪৩ টি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন সাহিত্যিক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় জাতীয় এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য প্রবন্ধনিবন্ধ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা মোট ২২টি। তার মধ্যে ১৭টি নাটক। এর মাঝে মৌলিক নাটক ৯টি।বেগম মুশতারী শফী দৈহিকভাবে নশ্বর হলেও তাঁর রেখে যাওয়া চেতনকথা, সাহিত্যকর্ম, আদর্শ কখনো মুছে যাবে না। অজর অমর অমলিন থাকবে তাঁর সৃষ্টিকর্ম, স্বপ্নবিশ্বাস। আমাদের প্রিয় আপা, বেগম মুশতারী শফী, আপনি বেঁচে থাকুন বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুলেখার নীল আকাশ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে