জীবন অনেক মূল্যবান- আত্মহত্যা মহাপাপ

অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | শুক্রবার , ১০ মে, ২০২৪ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আত্মহনন প্রবণতা

বলা হয়অনেক পূণ্যের ফল এই মানবজন্ম। তবে জীবনের পথ চলা কখনো সম্পুর্ণ কুসমার্স্তীণ নয়। আশা ও হতাশার এপারেওপারে সর্বক্ষণ মন দুলতে থাকে। মানব জীবনে মনোজগতের রসায়ন এতো জটিল, এসব পরিস্থিতিতে কেউবা আশা ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে জীবনকে নতুনতর রঙে সাজানোর পালায় অংশগ্রহণ করে। অন্যজন ছুটে যায় নিজকে সংহার প্রচেষ্টায়।

টিনএজে আত্মহনন প্রবণতা কেন তৈরি হয়, অনেক সাক্ষাৎকারে তার কারণাদি বেরিয়ে এসেছে। সে তখন এভাবে ব্যাপারটা বিশ্লেষন করেযে অবস্থায় সে পড়েছে, তা থেকে উতরানোর অন্য কোন পথ খোলা নেই। অথবা ভাবে, এতসব দুশ্চিন্তা বা কষ্টকর অনুভূতি থেকে রেহাই পাবার এটাই একমাত্র সমাধান।

কাউকে হারানোর বেদনা, কারো থেকে গভীর আঘাত পাওয়া, বা বড়সড় প্রত্যাখ্যানএ বয়সের মনকে সাগরের অতলে তলিয়ে দেয়। কেউবা কোনো ঘটনায় বেশ ক্রুদ্ধ হয়, কেউ এতে লজ্জাভারনত হয়ে থাকে, কেউ কেউ পাপবোধে ডুবে ভাবে যেবেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। জীবন ঘিরে তার সকল আকাঙ্ক্ষা যেন চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। কারো মনের ধারণাসে ফুল নয়, কাঁটা হয়েই জন্মেছে। তাকে কেউ আদর যত্ন করে না, ভালবাসে না, সুতরাং তার এই জীবনের কোনো মূল্য নেই।

গবেষণা তথ্য

বিশ্বব্যপী ১৫১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে চরম বিষন্নতা বোধ হতে ট্র্যাজিক আত্নহনন ঘটতে দেখা যায়। এর পেছনে কাজ করে সাইক্রিয়াট্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত নানা ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টরস্‌। একটা সার্ভেতে দেখা গেছেনবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী এক নাগাড়ে দুই বা ততোধিক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন হতাশার গভীরে নিমজ্জিত থাকে। তারা তাদের স্বাভাবিক কার্জকর্ম হতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজের জীবন নিয়ে তাদের প্রচন্ড অসন্তুষ্টি। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত।

তথ্যে এও দেখা যায়যেসব কন্যা শিশু দৈহিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের প্রায় ১৫২০ শতাংশ আত্নহনন পথ বেছে নেয়। দারিদ্রতা, পড়াশোনায় ভালো করতে না পারা, মাবাবার মধ্যে কলহ বা ডিভোর্স, ঘরে কারোর মৃত্যু, প্রিয়জন হতে বিচ্ছেদ প্রভৃতি এবয়সের চিন্তাজগতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। এই চাপ সামলাতে না পেরে তাৎক্ষণিকভাবে সুইসাইডের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত অনেকে নিয়ে নেয়।

ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা আত্মহননে বেশি প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু আত্মহনন প্রচেষ্টায় ৪ গুণ বেশি সফলকাম হয় ছেলেরা। মধ্যশৈশবে আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি। ১৭১৮ বছর বয়সের দিকে এসে, তা হ্রাস পেতে থাকে।

চাপা হতাশা:

হতাশাবোধ কেবল ব্যর্থতার অন্ধকারে চোখ রাখে, মেঘের আড়ালে সূর্য যে হাসতে পারে, সে কথা তখন মনে থাকে না। সমস্যা মোকাবেলা করে যে উত্তালসমুদ্রও পাড়ি দেওয়া যায়, সে চিন্তাশক্তি তার লোপ পায়। হতাশায় কোনো কোনো টিনএজ্‌ মন এমনভাবে বিদ্ধ হয়ে যায় যে, সে যে হতাশাক্রান্ত তাও মনে আসে না। ভাবে আর কিছুই করার নেই। হারিয়ে ফেলে স্বাভবিক সব বিচারবিশ্লেষণ ক্ষমতা।

মাদকাসক্তি:

হতাশা কাটাতে কেউ কেউ অ্যালকোহল বা মাদকের সন্ধানে যায়। আর এসব মাদক তাকে আরো ডিপ্রেশনে পেঁৗঁছে দেয়। তাতে আরও বাড়ে আত্মহনন ঝুঁকি।

সব আত্মহনন পরিকল্পিত না:

সন্তান হয়তো অনেক দিন ধরে বিষণ্নতায় নিমজ্জিত। হঠাৎ মাবাবা বা নিকটজনের সাথে বেশ বড়ধরনের ঝগড়া কিংবা অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, তাকে কফিনে শেষ পেরেক টুকে দেবার মতো পরিস্থিতিতে নিয়ে আসে।

অস্বাবাভিক আচরণ ও সতর্ক সংকেত

সুইসাইড বা ডেথ নিয়ে বেশি কথা বলছে।

চিরতরে চলে যাবার, হারিয়ে যাবার কথা বলছে বেশি বেশি।

হতাশা বা পাপবোধে জর্জরিত, এমন কথাবার্র্তা বেশি বলতে থাকা।

বন্ধু বা পরিবার হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

আগে যে সব কাজে তার উৎসাহ ছিলো, তা লোপ পেয়েছে বা সেসবে সে কিছুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে ন।

খাওয়া ও ঘুম অভ্যেসে বেশ পরিবর্তন।

নিজেকে শেষ করে দেওয়ার নানা নমুনাযেমন মদ্যপান, নিজের শরীরে নিজে নিজে আঘাত করা, কেটে ফেলা প্রভৃতি।

আত্মহননের চিন্তা থেকে উত্তরণের উপায়

এখনই কারো সাহায্য নেওয়া। কেননা হতাশার দৈত্য বেশ পরাক্রমশালী। তাই সময় নষ্ট না করে যাকে ভরসা করা যায়, তার সাথে খোলাখুলি আলাপ করা।

পড়াশুনার বয়সে নিজের ওপর একাডেমিক, সোশ্যাল বা নানাবিধ চাপ থাকে। বয়ঃসন্ধিতে বন্ধুত্ব, স্কুল, ভালোবাসা, বিশ্বাস সবকিছু মাকড়সার জাল বিছিয়ে দেয়। তবে জানা উচিতসব সমস্যার সমাধান আছে।

যারা ভালবাসে এবং পজিটিভ চিন্তা করে, সেসব লোকদের সাথে সর্বদা কথা বলা ও সংসর্গ রাখা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ চাওয়া। অনুধাবন করা হোক্‌-‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’, রবীন্দ্রসংগীতখানির মর্মবাণী।

পরিবারকে সন্তানের সকল সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কীভাবে সে এরুপ চাপ সামলাবে, তার পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবেজীবনে ঘাতপ্রতিঘাত থাকবেই।

সমস্যার সাগর নিশঙ্ক চিত্তে পাড়ি দেবার ব্রত হলো মনুষ্য জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি। ‘আত্মহত্যা মহাপাপতাকে এই বাংলা আপ্তবাক্য বারবার শোনানো দরকার। তাকে এও জানানো চাইজীবন অনেক মূল্যবান, তার সুরক্ষা মানবধর্ম।

লেখক: প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমার্কিনিদের মাঝে ইসলামের আলো : চেয়ে থাকবে শুধু মুসলিম বিশ্ব
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা