সাফা-মারওয়া : আল্লাহতায়ালার কুদরতি নিদর্শন সমূহের অন্যতম

ফখরুল ইসলাম নোমানী | বৃহস্পতিবার , ৯ মে, ২০২৪ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

মক্কা পাহাড়ের শহর। মক্কার উঁচু পাহাড় জাবালে নূরে উঠলে দেখা যায় পাহাড় আর পাহাড়। কাবা ঘরের তিন দিকেই পাহাড়। কাবা ঘর থেকে পূর্ব দিকে দুটি উঁচু পাহাড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে কাবার দিকে তাকালে বামের পাহাড়টি সাফা পাহাড় আর ডানের পাহাড়টি মারওয়া পাহাড়। আল্লাহতাআলার নির্দশনসমূহের মধ্যে সাফামারওয়া পাহাড় দুটিও অন্যতম। যা মসজিদে হারামের নিকটে অবস্থিত। আল্লাহতাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে হজের যে সকল আনুষ্ঠানিকতা শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করা বা দৌড়ানোও ছিল অন্যতম। সাফামারওয়াকে হজের রোকন করার রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য ও শিক্ষা। হজরত হাজেরা (.)-তার পুত্র হজরত ইসমাইল (.) কে রেখে পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। সাফা থেকে একবার গিয়েছেন মারওয়ায় আবার মারওয়া থেকে সাফায়। এভাবে সাতবার দৌড়েছেন। এ দৌড়ানো আল্লাহর খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আল্লাহর মেহমানদের জন্য দুই পাহাড়ের মধ্যে হাঁটা ও দৌড়ানো ওয়াজিব করে দিয়েছেন। বর্তমানে সাফা ও মারওয়া পাহাড় কেটে হাজিদের চলাচলের পথ সহজ করে দেওয়া হয়েছে। তিন তলা পথ করে দেওয়া হয়েছে ভিড় কমানোর জন্য। সাফা ও মারওয়া উভয় পাহাড়ের ওপর থেকে কাবা দেখা যেত। এ দুই পাহাড়ের ওপর দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়।

সাফামারাওয়া এই দুই পাহাড়ে হজরত হাজেরা (.)-সাত বার প্রদক্ষিণ করেছিলেন। হজওমরাপালনকারীদের জন্য সাফামারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো হজরত হাজেরার দৌড়ানোই ছিল মূল উৎস। হজরত ইবরাহিম (.) যখন হজরত হাজেরা (.) ও তার শিশুপুত্রকে খাদ্যসামগ্রী ছাড়া জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে রেখে গিয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে আনা খাদ্যসামগ্রী শেষ হয়ে যায়। তখন খাদ্যাভাবে হজরত ইসমাইল (.)-এর প্রাণ ওষ্ঠাগত। হজরত হাজেরা (.) অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জনমানবহীন মরু অঞ্চলের এ পবিত্র পাহাড় দুটির মধ্যে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। এক পর্যায়ে মধ্যবর্তী স্থানে স্বীয় আঁচল ছড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। সাফা পাহাড় দোয়া কবুলের স্থান। মারওয়া পাহাড় উত্তর দিকে পাঁচশত হাত দূরে অবস্থিত। মারওয়া পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে বামে মসজিদে হারামের দেয়ালের সাথে সবুজ রংয়ের একটি খুঁটি দেখতে পাবেন। খুঁটি থেকে ৪/৬ হাত দক্ষিণে থাকতে একটু দু্রতবেগে দৌড়ানো শুরু করবেন। এটা সুন্নাত। সেখান থেকে আনুমানিক একশত হাত উত্তরে আরেকটি খুঁটি আছে। সেই পর্যন্ত দৌঁড়াতে থাকবেন। এরপর স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। সাফা হতে মারওয়া পর্যন্ত পথকে ‘মাছয়া’ বলে। এই পথে দোয়া কবুল হয়। এখানে বিশেষ কোন দোয়া নেই। তবে এই দোয়া পড়তে পারেন। যার অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর। তুমি মহাপরাক্রমশালী, মহাসম্মানী। যখন মারওয়া পাহাড়ে যাবেন তখন সাফার মতই তাকবীর বলবেন এবং কাকুতিমিনতি সহকারে কিবলামুখি হয়ে দোয়া করবেন। কারণ এখানে দোয়া কবুল হয়ে থাকে। এভাবে এখানে এক পাক বা দৌড় শেষ হল। এরূপ সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার দৌড়ের পর সপ্তম পাক শেষ হবে মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে। সেখানেও দোয়া করে সায়ী শেষ করবেন।

অবশেষে মহান আল্লাহ হজরত হাজেরার (.)-দুঃখকষ্ট, চিন্তা দুর্ভাবনা দূর করে দেন। জনমানবহীন অঞ্চলকে মানুষের জন্য আবাসযোগ্য করেছেন। খাদ্য ও পানীয় দিয়ে তাদের সাহায্য করেছেন। বিশ্ববাসীর জন্য শ্রেষ্ঠ ইবাদতের স্থান নির্বাচন করেছেন। যা ছিল মহান আল্লাহর অপার রহমত ও করুণা। হজরত হাজেরার (.)-প্রার্থনার এ শিক্ষাকেই আল্লাহ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই হজের আনুষ্ঠানিকতায় সাফামারওয়া পাহাড়ে সাঈকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। আর তার কাছে কাকুতিমিনতির সঙ্গে দোয়া করার তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার শিক্ষাই হলো সাফামারওয়ার মূল তাৎপর্য। এ কারণে আলেমরা বলেন, অত্যন্ত আবেগ ও বিনয়ের সঙ্গে সাফামারওয়ায় সাঈ করতে। মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের অভাবঅনটন, প্রয়োজন এবং অসহায়তার কথা পেশ করতে। মনের সব জটিলতাকুটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে সুপথ প্রাপ্তির প্রার্থনা জানানো। জীবনের সব পাপ মোচনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। হজরত হাজেরা (.)-এর স্মৃতিবিজড়িত সাফামারওয়ার কার্যাবলির তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা এবং পালন করা মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পবিত্র পাহাড় দুটি তাওয়াফের সময় সমগ্র বিশ্ব থেকে আগত সকল দর্শনার্থী, হজ ও ওমরা পালনকারীর উচিত তারা যেন অত্যন্ত দারিদ্র্য ও বিনয়ের সঙ্গে সাফামারওয়ায় সাঈ করে। মহান আল্লাহ তাআলার নিকট নিজেদের অভাবঅনটন, প্রয়োজন এবং অসহায়তার কথা পেশ করেন। মনের সকল জটিলতাকুটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে সুপথ প্রাপ্তির প্রার্থনা জানান। জীবনের সকল পাপ মোচনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

আমাদের জন্য শিক্ষা : এক. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখা। যখন হাজেরা (.)-কে ইবরাহিম (.) নির্জন মরুপ্রান্তরে একাকী ছেড়ে যাচ্ছেন তিনি ইবরাহিম (.)-কে জিজ্ঞেস করলেন আপনি আমাদের এভাবে একাকী কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? তখন তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর কাছে আল্লাহর আদেশে। তখন হাজেরা বললেন তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না। তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে আল্লাহতাআলা এই নির্জন এলাকায় আমাদের রক্ষা করবেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৪) হাজেরা (.)-এর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা যে অনুকূলপ্রতিকূল যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহতাআলা মানুষকে সাহায্য করতে পারেন।

দুই. আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার পাশাপাশি নিজে চেষ্টা করা এবং উপায় অবলম্বন করা। যখন হাজেরা (.)-এর পানি শেষ হয়ে যায়। তখন আপাতদৃষ্টিতে তাঁর কাছে কোনো উপায় ছিল না। তথাপি তিনি বসে না থেকে এ মরুপ্রান্তরে চেষ্টা করে গেলেন।

তিন. ধারণাহীন জায়গা থেকে সাহায্য আসা। হাজেরা (.)-এর ঘটনা আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে যায় যে বান্দাকে আল্লাহতাআলা এমন উৎস থেকে রিজিক দান করেন যা কল্পনাও করতে পারবে না। শিশু ইসমাইলের পায়ের নিচ থেকে মাটি ফেটে পানির ফোয়ারা সৃষ্টি করে আল্লাহতাআলা মুমিনকে শিক্ষা দিয়েছেন যে আল্লাহতাআলা এভাবেই ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দান করতে সক্ষম।

হজরত হাজেরা (.) উভয় পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ির পর সন্তানের কাছে ফিরে এসে দেখতে পান হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামএর পায়ের নিচ থেকে মাটি ফেটে পানির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। হজরত হাজেরা পানির প্রবাহ রোধে পাথর দিয়ে বাঁধ দেন। আর মুখে বলতে থাকেন ‘জমজম’ থামো থামো। আর তখন থেকেই এ পানির উৎস কুপটি ‘জম জম কুপ’ হিসেবে পরিচিত। আর এ পানিকে বলা হয় জম জম পানি। আল্লাহতাআলার কুদরতে প্রাপ্ত এ পানি অনেক বরকতময় পানি। যাতে রয়েছে মানুষের জীবন ধারণে তথা জীবিকা নির্বাহের সব উপাদান। যাতে রয়েছে সব রোগের প্রতিষেধক। হজরত হাজেরার সাফামারওয়ায় দৌড়ানোর পুণ্যময় স্মৃতিকে তিনি তার নির্দশন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই হজ ও ওমরায় এ কাজকে রোকন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে সাফা ও মারওয়া তাঁর নির্দশন। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিৎ এ পাহাড়দ্বয়ে তাওয়াফ তথা সাঈ করে আল্লাহর বিধানের বাস্তবায়ন করা। আল্লাহতাআলা সকল মুসলমানকে সাফামারওয়ায় সাঈ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমঝোতা
পরবর্তী নিবন্ধএ শহরের আড্ডাগুলো