হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

গোপন কথাটি রবে না গোপনে/ উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে’। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভেবেছিলেন গোপনকথাটি গোপনই থেকে যাবে। গোপনেই সারতে চেযেছিলেন তিনি। কিন্তু কথাটি আর গোপন রইলো না। ফাঁস হয়ে গেল। যেন গলায় পড়লো ফাঁস। গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের ব্যাকইয়ার্ডগার্ডেনে ‘বুজ পার্টি’ (নড়ড়ুব ঢ়ধৎঃু) করে তিনি পড়লেন ভীষণ বেকায়দায়। অনেকটা হাতি যেমন কাঁদায় পড়ে, ঠিক তেমনটি। এমনই বেকায়দায় যে এখন তার সাধের গদি যায়যায় দশা। ‘বুজ পার্টিতে’ আহারের সাথে প্রচুর পরিমাণে পানীয়ের আয়োজন করা হয়ে থাকে এবং আমন্ত্রিতরা নিজের মদ নিজেই সাথে নিয়ে আনেন। পার্টি আয়োজন করা কিংবা যোগ দেয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু সময় যে বৈরী। বিশেষ করে যখন গোটা দেশে কোভিডের কারণে সকল প্রকার জনসমাগমসে ঘরে হোক আর বাইরেনিষিদ্ধ, ঠিক সেই সময় গোপনে নিজ ঘরে বরিস জনসন সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আয়োজন করেন ঘরোয়াপার্টির। একটি নয়, নিজ জন্মদিনসহ বেশ ক’টি। তাতে উপস্থিত ছিলেন দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সরকারি কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি মার্টিন রেনল্ডস ইমেইল পাঠিয়ে বরিস জনসনের সরকারি বাসভবনের পেছনের বাগানে আয়োজিত ওই পার্টিতে ডাউনিং স্ট্রিটের ১০০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আর তাতেই হলো কাল। আমাদের দেশের (বাংলাদেশ) বিচার্যে এ আর এমন কী অপরাধ। এর চাইতে কত বড় বড় অপরাধ করে বহাল তবিয়য়ে আছেন আমাদের দেশের ক্ষমতাধররা। উল্টো তাদের বলতে দেখা যায়, ‘সমালোচনা করলে করুক, আমরা তা থোড়াই কেয়ার করি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বৃটেন বলে কথা। সেখানে যে সবার, এমন কী রাষ্ট্রপ্রধানেরও জবাবদিহিতার ব্যাপার আছে। অভিযোগ যখন প্রথম উঠে তখন বরিস জনসন পার্লামেন্টে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, না, অভিযোগ সত্য। একটি মিথ্যেকে ঢাকতে তিনি বলে চলেন আরো অনেক মিথ্যে।

ফলে বর্তমানে দেশের জনগণসহ নিজ দলীয় ও বিরোধী দলীয় নেতাদের সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। অনেকে তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। সে দাবি যে কেবল বিরোধী লেবার পার্টি নেতাদের তা নয়, সে দাবি উঠেছে খোদ নিজ দল কনজারভেটিব পার্টির অভ্যন্তরে এবং তা তারা করেছেন প্রকাশে। বরিস জনসন ইতিমধ্যে বার কয়েক প্রকাশ্যে ও সংসদে ‘ক্ষমা’ চেয়েছেন। তার অফিস কক্ষে আয়োজিত তার জন্মদিনের পার্টি সম্পর্কে তিনি বলেন যে তিনি মনে করেছিলেন ওই পার্টি ছিল ‘অফিসিয়ালকাজ সংক্রান্ত’। তিনি ক্ষমা চেয়েছেন রানী এলিজাবেথের কাছেও। চাইতে বাধ্য হয়েছেন যখন দেখা গেল নিষেধাজ্ঞার কারণে রানী এলিজাবেথ উইন্ডসর কেসেলের সেন্ট জর্জ গীর্জায় তার স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে মুখে মাস্ক পড়ে একা বসে আছেন নীরবে। স্বামীকে শেষ বিদায়ের ওই অনুষ্ঠানে কেউ ছিলেন না রানীর পাশে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে। এই দৃশ্য সাধারণ জনগণের মনে খুব ছুঁইয়েছিল ও ব্যথিত করেছিল। কোভিডের কারণে খোদ দেশের রানী যখন নিয়ম মেনে চলেছেন, সেক্ষেত্রে দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণ অনেকের কাছে ‘ঔউদ্ধত্যপূর্ণ’ বলে মনে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত যে ‘পার্টি’ ছিল সেটি তার জানা ছিল নাএমনতর অজুহাতকে বিরোধী দলীয় নেতা, স্টারমার সংসদ অধিবেশনে ‘হাস্যকর’ ও আপত্তিকর’ বলে উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, বরিস জনসন বৃটিশ জনগণের সাথে প্রতারণা করেছেন, তিনি তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। ফলে তার ক্ষমতায় থাকার আর কোন অধিকার নেই। বিরোধী দলের অভিযোগ আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে, যখন বরিস জনসনের প্রাক্তন সিনিয়র এডভাইজার ডমিনিক কামিন্স গেল সপ্তাহে বলেন, তিনি শপথ করে বলতে পারবেন যে বরিস জনসন আগ থেকেই জানতেন যে এটি একটি ড্রিংকসপার্টি ছিল। তথাকথিত এই ‘পার্টি গেইট’ কেলেঙ্কারির অভিযোগ বাড়ার সাথে সাথে জনসনঅনুগতরা এই বলে দাবি করছেন যে এই সমস্ত অজুহাত মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে করা হচ্ছে। জনসন ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্তের জন্যে সরকারি কর্মকর্তা সু গ্রের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছেন, যা শীঘ্র জমা দেয়া হবে বলে জানা যায়। ডাউনিং স্ট্রিট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই কমিটির উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং রিপোর্ট কখন জমা দেয়া হবে তা ইনভেস্টিগেশন দলের উপর। এর পর লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ক্রেসিডা ডিক জানান, ‘গ্রে’র তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের হাতে এসেছে। এবার পুলিশ নিজের মতো করে তদন্ত করবে। তার অফিসাররা লকডাউনের সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং সরকারী বিভাগে সংঘটিত বেশ কয়েকটি পার্টিতে কোভিডবিধিগুলোর সম্ভাব্য লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করছেন।’ তবে গ্রের তদন্ত রিপোর্টে কী আছে, ক্রেসিডা তা জানাননি।

ইতিমধ্যে বরিস জনসনের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। তিনি এখন পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর সংকটে। গেল সপ্তাহে পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায়, দুই তৃতীয়ংশ ভোটার চান তিনি ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে, নিজ দলের অনেকেই তাকে এখন দলের জন্যে ‘বোঝা’ বলে মনে করেন। তার এই ‘পার্টি গেইট’ কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিমধ্যে তার দলের এক এমপি দল ত্যাগ করে লেবার পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। নিজ দলের ৬ জন এম পি বরিস জনসনের পদত্যাগ দাবি করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই দলে আরো অনেক এমপি যোগ দেবেন। সংকট আরো ঘনীভূত হতে শুরু করে যখন ফাঁস হয় যে দলীয় কোন এমপি যেন প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে না যায় সে কারণে কোন কোন সদস্যকে ইতিমধ্যে সরকার থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে এই বলে, তারা যদি এমনটি করেন তবে তাদের নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যে অর্থযোগান দেয়া হয় তা বন্ধ করে দেয়া হবে। বৃটেনের মত গণতান্ত্রিক দেশে এমন ‘রাজনৈতিক আচার বা অনাচার’ গণতন্ত্রের জন্যে যে ভয়াবহব্যাপার তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন আচরণ মনে করিয়ে দেয় ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাজকারবার। তার সাথে অনেক মিল বরিস জনসনের। জনগণের মতামত, দলীয় নেতা সদস্যদের মতামতকে উপেক্ষা করা, অশ্রদ্ধা জানানোর একটি ‘মনোভাব’ দুজনের মাঝে প্রবলভাবে দেখা যায়। ট্রাম্প পেরেছিলেন তার দেশে, দেশের আইন এককভাবে তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছিল। বরিস ক্ষমতায় বসে শুরুতে তেমনটি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৃটেন তো আর যুক্তরাষ্ট্র নয়। বৃটেনের জনগণ মার্কিন জনগণের চাইতে রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন। কথাটা জোর দিয়ে বলছি এই কারণে, তা যদি না হতো গণতন্ত্রের বারোটা বাঁজানোর পরও যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এখনো রাজনীতির গুঁটি ঘোরাতে পারতেন না। যাই হোকযে কথা বলছিলাম, কনজারভেটিব দলীয় এম পি উইলিয়াম রেগ এই বলে অভিযোগ করেন যে, ‘কয়েক পার্লামেন্ট সদস্য সরকারের পক্ষ থেকে চাপ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন, কারণ তারা ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের উপর ‘ভোট অফ কনফিডেন্স’ বা ‘আস্থা ভোট’ দাবি করবেন। তিনি এটিকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। জনসন এই অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ভীতি প্রদর্শনের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তার স্বপক্ষে তিনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। কনজেরভেটিভ দলের ১৫% আইন প্রণেতা (৫৪ জন) যদি তেমনটি দাবি করেন তাহলে বরিস জনসনের নেতৃত্বের উপর ‘আস্থা ভোট’ আনা সম্ভব। বরিস জনসনের অনুগত হিসাবে পরিচিত নর্থওয়েস্ট লাইচেস্টারশায়ারের এম পি এন্ড্রু ব্রিজেন সমপ্রতি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখেন, ‘আমাদের সরকারের ভেতর একটি নৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর আহবান জানাচ্ছি। সঠিক কাজটি করার এখনো সময় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগামী বছরগুলিতে বরিস ‘ব্রেক্সিট’ ও ‘মহামারী’ ইস্যুতে আমাদের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন”। ব্রিজেন ২০১৯ সালে বরিস জনসনকে টোরি দলের নেতৃত্বের জন্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং ব্রেক্সিটের পক্ষে বরিসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “নেতৃত্বে ব্যর্থ হওয়াতে তিনি বরিস জনসনের উপর আস্থা ভোটের যে দরখাস্ত দিয়েছেন তা দিয়েছেন ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে’। তবে বরিসও এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। এমনও হতে পারে তিনি নিজেই তার নেতৃত্বে আস্থা আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্যে নিজেই ‘আস্থা ভোটের’ ব্যবস্থা করতে পারেন। তাছাড়া এখনো পর্যন্ত দলের ভেতর তাকে ‘টেক্কা’ দেবার মত নেতা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। আগামীতে স্থানীয় নির্বাচন। তাতে যদি তার দল ভালো করতে না পারে, তবে হয়তো তাকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিছুটা সহজ হতে পারে বলে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের অভিমত। সাধারণ জনগণের মাঝে এখনো তার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। লন্ডনের দুদু’বার মেয়র থাকা এই বৃটিশ রাজনীতিবিদ রাজনীতিতে প্রবেশের আগে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। বৃটিশ পত্রিকা দি ডেইলী টেলিগ্রাফের ব্রাসেলস প্রতিনিধি ছিলেন বরিস জনসন। সে ১৯৮৯ সালের কথা। সে সময় তার লেখা নিবন্ধে ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে আসার পক্ষে তার মতামত দেখা যেত। এর পর ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি দি স্পেকটেটর ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন ২০০১ সালে, লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন ২০০৮ সালে এবং দ্বিতীয়বারের মত মেয়র নির্বাচিত হন ২০১২ সালে। ‘ব্রেক্সিট’এর পক্ষে জোড়ালো ক্যাম্পেইন করে তিনি আলোচিত হন গোটা দেশে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। ব্রেঙিটকে ঘিরে থেরেসা মেকে অকালে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হলে ক্ষমতায় বসেন বরিস জনসন। সে ক্ষমতা এখন কিছুটা টলটলে। কতটা টলটলে তা টের পাওয়া যাবে খুব শীঘ্র। ততদিন আমাদের অপেক্ষার পালা। লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের চেতনাসঞ্চারী বেগম মুশতারী শফী
পরবর্তী নিবন্ধকৃষি ও কৃষকের সুখ-দুঃখ