ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৭ মে, ২০২২ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল অপব্যবহার :
গেমিং ডিসঅর্ডার

যুদ্ধের সময় সৈন্যদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই মূলতঃ বর্তমান মোবাইল ফোনের আদি সংস্করণ ব্যবহৃত হতো। ভিয়েতনাম যুদ্ধে এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হয়। আবার ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরায়েলী সেনাবাহিনী মোবাইল প্রযুক্তির আরো উন্নত ব্যবহার করে, পরবর্তীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ তেমন না হওয়ায় মোবাইল প্রযুক্তির বাণিজিক ব্যবহার হয়। ১৯৯০ থেকে মোবাইল প্রযুক্তি যোগাযোগের ক্ষেত্রে মহা বিপ্লব সংঘটিত করতে থাকে। বর্তমান প্রতিটি সমাজে মোবাইল ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ উদ্বিগ্ন ও শংকিত। আমরা ডাক্তার হিসেবে মোবাইল অপব্যবহারের ফলে মানুষের শরীরিক ও মানসিক ক্ষতির দিকটা কিছুটা আবছা আবছা বলে আসছিলাম গত ২০ বছর থেকেই। কিন্তু ২০১৯ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রোগ তালিকায় মোবাইল অপব্যবহারকে বিধিবদ্ধ ব্যবহারগত রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এই রোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রোগ তালিকায় একটা নতুন রোগ এসে গেছে। মানুষ, মা-বাবা, পরিবারই এই রোগের ভেক্টর, অর্থাৎ মশা যেমন ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটায় তেমনি মা-বাবা, পরিবার, বাচ্চা, তরুণদের মাঝে এই রোগের অপব্যবহারের জন্য দায়ী বা জীবাণুবাহক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট তৈরী হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন আর্থ সামাজিক অবস্থানের ৫৬টি দেশে দশ বছরের সমীক্ষার ফল হিসেবে। এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে চার থেকে ২২ বছরের প্রজন্মের মধ্যে। এটা হচ্ছে প্রথম মোবাইল প্রজন্ম।
কোভিড-১৯ এর দুইটি বছরে গেমিং ডিসঅর্ডার ৭০ বয়োষর্ধ্ব প্রজন্ম ছাড়া সমস্ত জনসংখ্যাকে আসক্ত করে ফেলেছে। কোভিড পরবর্তী উপসর্গগুলোর মাঝে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানসিক অস্থিরতা তার অর্গান সংশ্লিষ্ট উপসর্গ থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা এখানে এই বয়স্ক জনগোষ্ঠীর উপর মোবাইল অপব্যবহারের বহুবিধ উপসর্গের প্রসঙ্গটা বাদ রেখে শুধু শিশু ও স্কুলগামী তরুণদের বিধ্বস্ত স্বাস্থ্যের বিষয়ে আলোকপাত করব।
নিদ্রা : মোবাইল থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্য আলোক তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়, এটাকে ‘ব্লু লাইট’ বলা হয়। ‘ব্লু লাইট শরীরের স্বাভাবিক মেলাটোনিন সিস্থেসিস প্রস্তুত কমিয়ে দেয়। ফলে ঘুমের যে সিগনাল তা কমে যায়। ফলে চাইলেও ঘুম আসে না, দেরিতে ঘুম আসে, সাউন্ড স্লিপ বা গভীর ঘুম ব্যাহত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনিদ্রা, মাথাধরা, ক্ষুধামন্দা, মেজাজ খারাপ, ধৈর্য ও মনোযোগের অভাব, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, যৌন শক্তি হ্রাস ইত্যাদিকে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ এর বা মোবাইল অপব্যবহারের উপসর্গ হিসেবে নথিভুক্ত করেছে৷
মেদবৃদ্ধি (Obesity) : যেহেতু মোবাইল অপব্যবহারকারীরা বাইরে যেতে চায় না, খেলতে চায় না, শুধু শুয়ে থাকে তাদের মধ্যে অনলাইন খাবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাই এরা ওজন বৃদ্ধি ও মেদবৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকে। কম বয়সেই হৃদরোগের মুখে পড়ে।
ঘাড় ব্যথা, পিট ব্যথা : একই পজিশনে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে সার্ভাইক্যাল ডিসকমফোর্ট বা ঘাড়, পিঠ, কোমরে ব্যথা অনুভূত হয়। এর কোনো সুরাহা নেই৷
মানসিক স্বাস্থ্য: মোবাইলে অনেক অ্যাপস থাকে। হেন কোন বিষয় নেই যে তার অ্যাপস যুক্ত ব্যবহার নেই, মানুষ দেখা না করে এসএমএস করে। যে কথা সামনাসামনি বলা যায় না তা অনায়াসে ছড়িয়ে দেয়া যায়। বাইরে, দোকানে, রাস্তায় মানুষের সাথে ইন্টারেকশন দ্বারা ব্যবহার আবেগ, অনুভূতি, যেরকম চর্চা হয় মোবাইল এর মাধ্যমে তা কখনো সম্ভব হয় না। মোবাইল জেনারেশন রাস্তাঘাটে সম্মুখীন হওয়া হরেক রকম পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। মানুষ ব্যক্তিত্বহীন ও ব্যবহারিক বহির্ভুত Diindividuated বা dicommunicated সৃষ্টিতে পরিণত হয়।
আসক্তি : মোবাইল ব্যবহার ক্রমান্বয়ে আসক্তিতে পরিণত হয়, গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ৫৯ পার্সেন্ট ব্যবহারকারী মোবাইল ব্যবহার না করে একদিনও থাকতে পারেনা, মোবাইল খুজে না পেলে বা হারিয়ে ফেললে ২৪ ঘন্টার ভিতরে ৮০% ব্যবহারকারী নতুন মোবাইল কেনার জন্য পাগল হয়ে যায়। ব্যবহারকারীদের কোন নির্দিষ্ট অ্যাপ ব্যবহার না করতে বললে শতকরা ২০ জন মোবাইল ছুঁড়ে মারে ও পরিবারে ভায়োলেন্স করে।
চক্ষু ও দৃষ্টি: ৮০% ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে চোখে নানারকম সমস্যা অনুভব করে, ঘনঘন চশমা বদলাতে হয়, মাথা কামরায়, বমি ভাবও দেখা যায়, দৈনিক ৩০ মিনিটের বেশি মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ডিমেনশিয়া স্মৃতিভ্রম ১০ বছর আগে দেখা দেয়।
এক এক দেশে মোবাইল অপব্যবহার বা গেমিং ডিসঅর্ডার এক এক রকম। বাংলাদেশে দৈনিক গড়ে ৩০০ টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তি ৬০-৭০ টাকা মোবাইল বিল দেয়। মোবাইল কোম্পানিগুলো দরিদ্র শ্রেণি থেকেই বেশি রেভিনিউ পায়। দরিদ্র, শ্রমিক, সিএনজি ড্রাইভার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে বেশি খরচ করে মোবাইল বিলে।
মুম্বাইয়ের Sion Hospital এর ডা: হর্ষালকুল মহাজন’ যেসব স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা ৩০মিনিটের বেশি মোবাইল দেখে তারা ৩০ মিনিটের কম ব্যবহারকারীদের থেকে দ্বিগুণ খারাপ ফল করে পরীক্ষায়, দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ুতে ছোট বাচ্চাদের ব্যাপকহারে ডিমেনশিয়া স্মৃতিভ্রম ও পড়া মনে রাখতে না পারার ঘটনা বাড়ছে।
মোবাইল মহামারী থেকে বাচ্চা ও স্কুল পড়ুয়াদের বাঁচাতে কি করতে হবে? ছেলেবুড়ো ৩০ মিনিটের বেশি মোবাইল ব্যবহার মানেই রোগবালাই ডেকে আনা, মোবাইল বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। বয়স্কদের ও ঘুমানোর আগে মোবাইল নাগালের বাইরে রাখতে হবে, প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ব্যবহার না করলে প্রযুক্তি গোটা সমাজকে স্থবির করে ফেলবে। স্কুল-কলেজে ও সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল বিহীন প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। রোগ যেমন ঔষধ এর অভাবে ক্রমান্বয়ে ক্রনিক হয় তেমনি গেমিং ডিসঅর্ডার কে আমরা যদি এখনই সুবুদ্ধি ও সুবিবেচনা দিয়ে প্রতিহত না করি তবে বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ার, মনন, চিন্তা সবই ধ্বংস হবে। বাচ্চাদেরকে খেলাধুলা, সাঁতার সর্বোপরি বই থেকে গল্পবলা ও শোনানোর অভ্যাস অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআপনার রক্তচাপ মাপুন, তা নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘায়ু হোন
পরবর্তী নিবন্ধজননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন