আপনার রক্তচাপ মাপুন, তা নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘায়ু হোন

প্রফেসর ডা. প্রবীর কুমার দাশ | মঙ্গলবার , ১৭ মে, ২০২২ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

উচ্চ রক্তচাপ এক নিরব ঘাতক। প্রায় ক্ষেত্রে তা কোন উপসর্গ ছাড়া চলতে থাকে এবং স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, হৃৎপিণ্ডের ছন্দহীনতা, কিডনী রোগ, স্মৃতি শক্তি বিলোপ সহ শরীরের রক্তনালীর বিভিন্ন অসুখ সৃষ্টি করে। এভাবে সারা বিশ্বজুড়ে তা ভোগান্তি ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে উচ্চ রক্তচাপ নিরব ঘাতক হলেও তা অচেনা নয়। তাকে সনাক্ত করা যায় খুব সহজেই। এই ঘাতককে ধরতে কোন সিসিটিভি ফুটেজ প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন কেবল সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপ এতে তা সনাক্ত হয় সহজেই। সনাক্তের পর তা নিয়ন্ত্রণ করলে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সকল জটিলতা প্রতিরোধ করা যায় এবং দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। তাই বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস, ২০২২ এর প্রতিপাদ্য, ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন তা নিয়ন্ত্রণ করুন ও দীর্ঘায়ু হোন।
উচ্চরক্তচাপ ক্রমবদ্ধমানঃ সারাবিশ্বে ১ বিলিয়ন লোক উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত বিশ্বে তা রোগীদের চিকিৎসকের চেম্বারে ভিজিটের প্রধান কারণ। এখানে চিকিৎসকদের ব্যবস্থা পত্রে স্থান পাওয়া ওষুধের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধই সর্বোচ্চ। আমেরিকায় প্রতি দুইজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত। বাংলাদেশে শতকরা ২২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং অর্ধেকেরই বেশী বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত। বয়োবৃদ্ধিতে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বাড়তে থাকে। ৩০ বছর বয়সের পর থেকেই তা বাড়ে উত্তোরোত্তর এবং যাদের বয়স ৭৮ তাদের শতকরা ৯০ ভাগই উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত। ৫০ বছরের কম বয়সী মহিলাদের রক্তচাপ সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় কম থাকে। তবে মাসিক বন্ধ হবার পর রক্তচাপ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং তা পুরুষদের ছাড়িয়ে যায়। মানুষের গড় আয়ুবৃদ্ধি, খাদ্যভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন, মেদ বাহুল্যের বারবারন্ত অবস্থার কারণে বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশ সমূহে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপের এই ঊর্ধ্বগতি এখানে হৃদরোগের আশংকাজনক প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। ধারণা করা হয় ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবে।
সঠিক পরিমাপ কেন জরুরী ? উচ্চ রক্তচাপ প্রায়শ কোন উপসর্গ ছাড়াই থেকে থাকে। এভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলমান উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ড, মস্তিস্ক, কিডনী, স্ট্রোক ও শরীরের বিভিন্ন রক্তনালীর ক্ষতি সাধন করে। তা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় উচ্চ রক্তচাপ সনাক্ত করে তা নিয়ন্ত্রণ করা। তার জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপ। আবার উচ্চ রক্তচাপগ্রস্তদের ক্ষেত্রে গৃহীত চিকিৎসায় রক্তচাপ কাঙ্খিত সীমানায় নিয়ন্ত্রিত থাকছে কিনা তা বোঝার ও একমাত্র উপায় রক্তচাপ পরিমাপ। কারণ রক্তচাপ সারাজীবন অসুখ। তা একেবারে নিমূর্লের কোন ব্যবস্থা নেই। তবে ওষুধ চিকিসায় ও জীবনযাত্রা পরিবর্তনে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতিতে অনেক অত্যাধুনিক রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা এসেছে কিন্তু রক্তচাপ পরিমাপের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দিতে প্রবর্তিত পদ্ধতিই এখনো একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা। তবে পারদ ও এনেরনেড যন্ত্রের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র এসেছে। সঠিক পরিমাপের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ সনাক্ত করা এবং উচ্চ রক্তচাপগ্রস্তদের রক্তচাপ সুনিয়ন্ত্রিত রাখার উপর গুরুত্ব অরোপিত হয়েছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবসের প্রতিপাদ্যে।
সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপে করণীয় ঃ উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপে সচরাচর ব্যবহৃত দুটো যন্ত্রের মধ্যে সর্বজনস্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য হচ্ছে পারদের চাপমান যন্ত্র। একই কারণে রক্তচাপকে সবসময় মি.মি পারদের এককে প্রকাশ করা হয়। পারদ কিংবা এনেরয়েড যে যন্ত্রই ব্যবহার করেন রক্তচাপ পরিমাপ পদ্ধতি অবশ্য একই। তা আপনি করতে পারেন হাতের অনুভবে কিংবা যান্ত্রিক শ্রবণ প্রক্রিয়া। হাতের অনুভব প্রক্রিয়ার প্রথমে ব্‌্রাকিয়াল ধমনী আঙ্গুল দিয়ে অনুভব করুন। বাহু বন্ধনীর চাপ তাড়াতাড়ি তুলে তা নাড়ি বিলুপ্তির ৩০ কি.মি উপরে নিয়ে যান। তারপর ধীরে ধীরে বাহুবন্ধনীর চাপ অবমুক্ত করুন। নাড়ী ফিরে আসার চাপই সিস্টোলিক চাপ। যান্ত্রিক শ্রবণ প্রকিৃয়ায় বাহুবন্ধনীর চাপ অবমুক্ত করার সময়ে ব্রাঙ্কিয়াল ধমনীর উপর রাখা স্টেসোসকোপের প্রথম শব্দ শোনার চাপই সিস্টোলিক চাপ এবং শব্দ পুরোপুরি চলে যাওয়ার সময়করে চাপই ডায়াষ্টোলিক রক্তচাপ।
হ রক্তচাপ মাপার আগে আরামদায়ক ভাবে একটা শান্তরুমে কিছু সময় বিশ্রামে থাকুন।
হ উপযুক্ত সাইজের বাহুবন্ধনী বাহুতে জড়িয়ে দিন। তা যেন খুব হালকা কিংবা খুব আটসাট না হয়। বাহু বন্ধনীর নীচের প্রান্ত কনুইয়ের ২ সেমি উপরে থাকবে।
হ বাহু বন্ধনী হৃদপিণ্ডের একই সমতলে আছে কিনা তা নিশ্চিত হোন ; রোগীর অবস্থান যাই হোক না কেন।
হ পাম্প করে বাহুবন্ধনী চাপ বৃদ্বি করুন যতক্ষণ পর্যন্ত না কব্জি নিকটস্থ রেডিয়াল নাড়ী বন্ধ হয়। চাপমান যন্ত্রে এ সংখ্যাটি লক্ষ্য করুন। তারপর চাপ আগের সংখ্যার ৩০ মি.মি উপরে তুলুন।
হ এবার চাপ ধীরে ধীরে কমান; সেকেন্ড ২-৩ মি.মি। বাহুবন্ধনীর চাপ অপসারণকালীন ব্রাকিয়াল ধমনীতে রক্ত প্রবাহ শুরুর সময় প্রথম শব্দ শোনার মুহূর্তের চাপই সিস্টোলিক চাপ। আর শব্দ যখন সম্পূর্ণ চলে যায় তখনকার চাপই ডায়াস্টোলিক চাপ।
হ যখন সব শব্দ চলে যায় তখন বাহু বন্ধনী তাড়াতাড়ি এবং সম্পর্ণরূপে বায়ু শূন্য করুন।
হ একই বাহুতে পুনর্বার রক্তচাপ মাপার আগে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন।
হ এই পরিমাপগুলোর গড় করুন। যদি প্রথম দুটো পরিমাপের মধ্যে সিস্টোলিক ৬ মি.মি. অথবা ডায়াস্টোলিক ৪ মি.মি বেশি পার্থক্য হয় কিংবা যদি প্রথম পরিমাপ খুব বেশী পাওয়া যায় তবে পরিপূর্ণ বিশ্রামের পর আরো একবার মেপে দেখুন।
হ প্রথমবার উভয় বাহুতে রক্তচাপ মেপে দেখুন, বিশেষত দু’দিকে নাড়ীর গতির পার্থক্য রয়েছে মনে হলে দু’দিকের রক্তচাপের ৫মি.মি. পর্যন্ত তারতম্য গ্রহণযোগ্য। তারতম্য অনেক বেশী হলে যে পরিমাপটা বড় সেটাই গ্রহণ করবেন।
হ বয়স্কদের ক্ষেত্রে বসা এবং দাঁড়ানো অবস্থায় রক্তচাপ পরিমাপ করুন। ডায়াবেটিক রোগী এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে তা করা আব্যশক।
হ স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে আপনি নিজে নিজে ঘরে রক্তচাপ মাপতে পারেন। তার জন্য আপনার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এবং তা মাঝে মাঝে উপরোক্ত পদ্ধতির সাথে তুলনা করে দেখা আবশ্যক।
এভাবে পরিমাপে আপনার রক্তচাপ ১২০/৮০ মি.মি. এর নীচে হলে আপনি সবচেয়ে অনুকূল রক্তচাপের অধিকারী। আপনার রক্তচাপ ১২০/৮০ মি.মি এবং ১৪০/৯০মি.মি. এর মধ্যবর্ত্তী সীমানায় হলে তবে ভবিষ্যতে আপনার রক্তচাপ বাড়ার আশংকা রয়েছে। জীবন যাত্রায় পরিবর্তন মেনে চলুন। আর আপনার রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি কিংবা তার বেশী হলে আপনি উক্ত রক্তচাপে ভুগেছেন। তা কমাতে জীবন যাত্রার পরিবর্তন ও ওষুধ সেবন আবশ্যক। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিন। রক্তচাপের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অফিসের পরিমাপের চেয়ে রোগীর গৃহ পরিবেশের পরিমাপ সঠিক হিসাবে স্বীকৃত। তবে তা উপরোক্ত নিয়ম মেনে সঠিকভাবে করতে হবে। বর্তমানে ২৪ ঘন্টাব্যাপী চলমান রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা আছে। ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসকের পরামর্শ তা গৃহীত হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ সনাক্তকরণে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জীবন যাত্রার পরিবর্তনঃ
হ খাদ্যে লবন সীমিত করুন। পাতে লবন পরিহার করুন। লবনাক্ত খাবার যেমন ফাস্টফুড, চিপস, চানাচুর ইত্যাদি পরিহার করুন।
হ খাদ্যভ্যাস পরিবর্তন করুন। চর্বিযুক্ত খাবার কমান, রান্নার তেল সীমিত করুন। শাকসবজি, ফলমূল, শস্য জাতীয় খাবার বেশি খান।
হ মেদ বাহুল্য পরিহার করুন। শরীরের আদর্শ ওজন বজায় রাখুন।
হ ধূমপান, মদ্যপান, বর্জন করুন।
হ নিয়মিত ব্যায়াম করুন, দৈনিক কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটুন।
হ মানসিক চাপ কমান, মেডিটেশন করুন।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ সনাক্তকরণ ও তা নিয়ন্ত্রণের চিত্র এখনও হতাশাজনক। জরিপে দেখা যায়, উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কবল অর্ধেকের তা সনাক্ত হয়; আবার তাদের কেবল অর্ধেক চিকিৎসা গ্রহন করেন এবং তাদেরও অর্ধেকের রক্তচাপ চিকিৎসায় সুনিয়ন্ত্রিত থাকে। এটাই উচ্চরক্তচাপের “অর্ধেকের নিয়ম”। দেখা যাচ্ছে এই তিন ক্ষেত্রে অর্ধেকাংশ দৃষ্টির অন্তরালে থেকে যায়, তা অনেকটা সাগরের হিমশৈলের মতো, যার অর্ধেকাংশ দৃশ্যমান বাকিটা পানির নীচে থেকে যায়। উচ্চ রক্তচাপের সঠিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপ। জীবন যাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ গ্রহণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে নিদিষ্ট সময়ান্তে চেক আপ। তবে আর্থসামাজিক অবস্থা এতে অন্তরায়। একাধিক রক্তচাপ কমানো ওষুধের বোঝা, খরচ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, রোগী শিক্ষায় চিকিৎসকদের স্বল্প সময় বরাদ্দ করা, ওষুধ উপসর্গ নেই বলে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ গ্রহণে রোগীর অনীহা-এসব উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অন্তরায়। এভাবে খোদ আমেরিকায় অর্ধেকেরও বেশী উচ্চ রক্তচাপের রোগীর রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থেকে যায়। উচ্চ রক্তচাপের সাথে বিদ্যমান আনুসঙ্গিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন, ডায়াবেটিস, রক্তের উচ্চ কোলেষ্টেরল ইত্যাদির ওষুধের প্রয়োজনীয়তা উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসাকে আরো ব্যয়বহুল করে তোলে। এই ধরনের বাস্তবতায় বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে। উচ্চ রক্তচাপ সনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডকে সাফল্যমণ্ডিত করতে বাংলাদেশ হাইপারটেনশন এন্ড হার্ট ফেইলিউর ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে। এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উচ্চ রক্তচাপ সনাক্তকরণ ও তার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দীর্ঘ, উৎপাদনশীল জীবনমান নিশ্চিত করাই হোক আজকের অঙ্গীকার।
লেখক : প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ হাইপারটেনশন এন্ড হার্ট ফেইলিউর ফাউন্ডেশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহজরত মাওলানা মোহাম্মদ মুস্তাকীম হাসেমী (র.) আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ ও
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল