হজরত মাওলানা মোহাম্মদ মুস্তাকীম হাসেমী (র.) আমানউদ্দীন আবদুল্লাহ ও

ড. সেলিম জাহাঙ্গীর | মঙ্গলবার , ১৭ মে, ২০২২ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

উজবেকিস্তানের বুখারা নিবাসী হজরত বাহাউদ্দীন নক্সবন্দ (র.) নক্‌শবন্দীয়া তরিকার ধারায় প্রায় ২৫০ বৎসর পরে ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ নগরে একজন আলোড়ন সৃষ্টিকারী বুজর্গের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর নাম হজরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (র.) (৭৯১-১০৩৪ হি.)। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বানোয়াট ধর্ম ‘দ্বীন ইলাহী’ কে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামের অভাবনীয় সংস্কার সাধন করে তিনি ‘মুজাদ্দিদ আলফেসানী’ নামে বিশেষ পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর এই অসাধারণ কৃতিত্বের ধারাবাহিকতায় নক্‌শবন্দীয়া তরীকার অঙ্গসৌষ্ঠভকে আরো মহিমামণ্ডিত করে প্রকাশ ঘটে মুজাদ্দেদীয়া তরীকার। এ তরীকারই ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন পর্যায়ে পেরিয়ে প্রায় তিনশত বৎসর পরে ভারতের উত্তর প্রদেশের রামপুর শহরে মারিফাত জগতের এক উচ্চমার্গীয় বুজর্গের আবির্ভাব হয়। শাহ হাফেজ ইনায়াত উল্ল্লাহ খান রামপুরী নামে তিনি সমাধিক পরিচিত। এভাবে কাল পরিক্রমায় এ তরীকা তাঁরই সুযোগ্য প্রতিনিধি গণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। রামপুরের খানকাহ শরীফে দীক্ষাপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সূফী সাধক শায়খুল হাদীস হজরত মাওলানা সফিরুর রহমান হাশেমী (১৮৮৫-১৯৫৫) এর পরিশুদ্ধ ব্যক্তিগত জীবনাচরণ এবং কঠোর কঠিন রেয়াজত এবং অনুশীলনের ফলশ্রুতিতে এ তরীকা চট্টগ্রামের বুকে তাসাউফ জগতে এক অনন্যসাধারণ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। পীর ছাহেবের এজাজত নিয়ে তদীয় পীর ভাই হজরত মাওলানা বেসারত আলী (র.) (১৮৮৫-১৯৭৫) সমভিব্যহারে তিনি চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। এখানে এসে আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তদীয় একমাত্র পুত্র হজরত মাওলানা মুস্তাকীম হাশেমীর পীর ভাইয়ের কন্যার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাঁদের সুদীর্ঘ পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন মাত্রিকতা লাভ করে।
পিতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হজরত মাওলানা মোহাম্মদ মুস্তাকীম ছাহেব শৈশবে ভারতের রামপুরের মাদ্রাসা আলীয়া এবং পরবর্তীকালে লাহোরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা সমাপন করে তিনি মর্যাদাপূর্ণ জীবন জীবিকার প্রশ্নে সিলেট তিব্বিয়া কলেজে হেকিমী শিক্ষা লাভ করেন। তিব্বিয়া কলেজের অধ্যয়ন শেষে তিনি চট্টগ্রাম এসে বুজর্গ পিতার সান্নিধ্যে মারিফাতের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রাখেন।
ইতোমধ্যে ১৯৫৫ সনে তদীয় বুজর্গ পিতা ইন্তেকাল হলে সমকালীন বিশিষ্ট আলেমগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ক্রমে তিনি নামাজে জানাজার ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। নিভৃতচারী এই আধ্যাত্মিক সাধক হজরত মাওলানা মুস্তাকীম হাসেমী ছাহেব, তদীয় পিতা কর্তৃক ১৯৩৫ সালে স্থাপিত আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে খানকাহ-এ সফিরিয়া ও হাশেমী দাওয়াখানায় আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড এবং হেকিমী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে থাকেন। একে কেন্দ্র করে জাগতিকভাবে হাশেমী দাওয়াখানার আবরণ এবং আভরণে চলতে থাকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের চর্চা ও অনুশীলন, যা তরীকত পন্থীদের সংপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে অতি সহজে। সে কারণেই তরীকতের অনুসারী ছাড়াও সমাজ জীবনের মননশীল বিশিষ্ট জনেরা তাঁর কাছে ছুটে আসতেন একান্ত করুণা লাভের আশায়। পিতার ওফাতের পরে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হিসেবে প্রাপ্ত তদীয় পীর ভাই, হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র) এর সুযোগ্য বংশধর, হজরত শাহজাদা মুহাম্মদ ফৌজুল আজীম খান এর একান্ত সাহচর্যে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ডে তাঁর ঐকান্তিক অংশগ্রহণের বিষয়টি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য।
নিজেকে অত্যন্ত সচেতনভাবে গুটিয়ে রাখলেও আল্লাহ পাকের হুকুমে সত্যসন্ধানী লোকজন তাঁর সান্নিধ্যে আগমন করতে থাকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্লেখযোগ্য দু’জন হলেন হালিশহর নিবাসী জনাব আজীমুল হক ও বাবুল হক। প্রসঙ্গত এ কথা স্মরণীয় যে, তদীয় পিতা হজরত মাওলানা সফিরুর রহমান হাশেমীর প্রথম মুরিদ ছিলেন হালিশহরের অধিবাসী, যে বিষয়টি রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখে।
নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার মূলনীতি লোকালয়ে অবস্থান করেও নিজেকে লুকায়িত রাখা। এ বিশেষত্বকে তিনি ধারণ, লালন এবং প্রতিপালন করেছিলেন সমগ্র জীবন সত্তায়। নীরবতা, মৌনতা এবং মৃদু ভাষণের মধ্যেও যে কী প্রচণ্ড শক্তি নিহিত থাকতে পারে তার এক উজ্জ্বল চলমান দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। এর সাথে যুক্ত ছিলো তাঁর তুলনা রহিত আতিথেয়তা, যা তরীকত এবং তরীকত বহির্ভূত সকলশ্রেণী পেশার মানুষকে আকর্ষণ করতো বিশেষভাবে। একান্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শরীয়তের বিধি বিধান অনুসরণ ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে তাঁর আজীবন সাধনা ছিলো রীতিমতো কিংবদন্তীতুল্য। সেক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ ছাড়ও তিনি কখনো কোনো অবস্থায় দিতেন না। তাঁর এই অনুকরণীয় বিশেষত্ব আলেম সমাজ এবং তরীকত জগতের সর্বমহলে, বিশেষ করে এই তরিকার আধ্যাত্মিক কেন্দ্র রামপুর শরীফেও বিশেষভাবে আলোচিত হতো।
জাগতিক জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তিনি ভোগ করতেন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। আল্লাহ পাকের মর্জির উপর অবিচল আস্থা এবং তার যথাযথ অনুসরণ ছিলো হজরতের জীবনে অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এমন কি জীবনাচরণের সর্বক্ষেত্রে যে পরিমিত বোধ ক্রিয়াশীল ছিলো সর্বক্ষণ তার যথাযথ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন তদীয় সন্তানদের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন যথাক্রমে তদীয় প্রথম ও দ্বিতীয় ছাহেবজাদা।
১১ আগস্ট ২০১৪, সোমবার দিবাগত রাত ৯টা পঞ্চাশ মিনিটে হজরত তদীয় পিতার রওজা শরীফ সংলগ্ন বাস ভবনে পরিবারের সদস্য এবং অনুরক্তদের উপস্থিতিতে বেসালে হাকিমী লাভ করেন। পরদিন সকালে জনসমুদ্রের বিশাল উপস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রয়োজন পর পর তিনবার নামাজে জানাজা শেষে তদীয় পিতা এবং মুর্শিদ হজরত মাওলানা সফিরুর রহমান হাশেমী (র.) এর ফৌজদার হাটস্থ রওজা শরীফ প্রাঙ্গণে হজরতকে দাফন করা হয়। আমরা তাঁকে স্মরণ করি পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধায়।
লেখকদ্বয় : প্রাবন্ধিক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবুলবুল চৌধুরী : আধুনিক নৃত্যকলার এক অনন্য পথিকৃৎ
পরবর্তী নিবন্ধআপনার রক্তচাপ মাপুন, তা নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘায়ু হোন