বিড়ম্বনার আরেক নাম এনআইডি ও জন্মনিবন্ধন

বাসুদেব খাস্তগীর | বুধবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলা অভিধানে বিড়ম্বনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অনর্থক দুর্ভোগ ভোগ করা।’ এই অনর্থক দুর্ভোগ শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এদেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামরিক বাহিনির তত্ত্বাবধানে প্রথম জাতীয় পরিচয় প্রদানের কাজ শুরু হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সেই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন সময়ে সময়ে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করছে। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরির কাজ যে সমস্ত লোকদের দিয়ে তৈরি করার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো তারা ছিলো নিতান্তই আনাড়ি-তাদের বাংলা, ইংরেজি বানান সম্পর্কে সম্ভবত কোনো ধারণাই ছিলো না। অজস্র বানান ভুলে এসব জাতীয় পরিচয় পত্রের মালিকরা এখন এসব শুদ্ধ করার মহাযুদ্ধে লিপ্ত। এসব শুদ্ধ করতে গিয়ে কী যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। অথচ এসব তৈরির সময় একটু সচেতন হলেই এসব ভুল এড়ানো সম্ভব ছিলো। অন্যের ভুলের এখন খেসারত দিচ্ছে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। তার টাকা পয়সা শ্রম সময় সব অপচয় করেও সঠিক সময়ে তার সুরাহা হচ্ছে না অনেকেরই। এখন ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ই-পাসপোর্ট বানানো, করোনার টিকা গ্রহণ, জমি ক্রয়-বিক্রয় সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে জাতীয় পরিচয়পত্র অপরিহার্য একটি প্রমাণপত্র। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নাম, জন্ম তারিখসহ নানা ক্ষেত্রে যেন ভুলের মহোৎসব। ব্যাংক একাউন্ট খোলা, বিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি, বিদেশ গমন, পাসপোর্ট তৈরি, জমিজমা বিক্রিসহ নানা প্রয়োজনীয় কাজে এনআইডি ও জন্ম নিবন্ধনের সনদগুলোতে নানা অসামঞ্জস্যতার কারণে পদে পদে জনগণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। কারও বাংলা বানানে ভুলে, কারও ইংরেজি বানানে ভুল বা জন্ম তারিখ, সার্টিফিকেটের সাথে মিল নেই, সব মিলিয়ে এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সার্টিফিকেটে ভুল থাকলে তা সংশোধন করাও অনেক ঝামেলার কাজ। এখন একজন মানুষের জীবনের সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয় পত্র ও পাসপোর্টের মত গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোতে মিল না থাকলে তার পড়াশুনা, বিদেশ গমনসহ নানা কাজে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবেই। এগুলো শুদ্ধ করার সহজ সরল পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা দরকার। কারণ এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ এখনও অশিক্ষিত। তাদের কাছে পরিচিতিকরণে এনআইডি ও জন্মনিবন্ধনই ভরসা। এগুলো ঠিক করতে গিয়ে টাকা পয়সাসহ নানা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মানুষ এখন অতিষ্ঠ। এগুলো তৈরি করার সময় প্রকৃত শিক্ষিত মানুষদের দায়িত্ব দিয়ে, প্রয়োজনে প্রুফ কপি দেখিয়ে তৈরি করার প্রক্রিয়া করা যেতে পারে। এ কর্মযজ্ঞ করার পূর্বে নিয়োগকৃত লোকদের প্রশিক্ষণও দরকার এবং প্রয়োজন একটি প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনি। একজন অশিক্ষিত মানুষের নিকট তার জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অশিক্ষার কারণে তার জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনে সে কী করবে ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছে না। এত তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও দেখা যায় এখন এগুলো তৈরি করতে নানা ভুল হচ্ছে এবং তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ জনগণ। সুতরাং এগুলো কীভাবে শুদ্ধভাবে তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছে দেয়া যায় তার জন্য পরিশীলিত চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। অজ্ঞতা বা অবহেলাজনিত এ ধরনের ভুল মানুষ মাসের পর মাস দৌড়াদৌড়ি করেও নিষ্পত্তি করতে পারছে না। তার কারণে তারা নানামুখী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অতি সমপ্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিক আইডি তৈরির এক কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। সেই ইউনিক আইডি তৈরিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর মা বাবা সহ তার নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত প্রয়োজন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মা-বাবার আইডির সাথে জন্ম নিবন্ধনের তথ্যের মিল নেই, আবার সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেটের সাথে তার জন্মনিবন্ধনের মিল নেই। একটি ভুল সংশোধন করতে গিয়ে জনগণ এমনি কী ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা সহজেই অনুমেয়, সেখানে ছাত্রীছাত্রীদের জন্য ভবিষ্যৎ ইউনিক আইডি তৈরির নিমিত্তে কোন ভুল তথ্য নিয়ে তা তৈরি করা হলে ভবিষ্যতে সে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। গ্রামাঞ্চলে এখনও সাধারণ শিক্ষিত মানুষের তো আছেই, স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রেণির লোকেরও জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি অজস্র ভুলে ভরা। অথচ তাদের অনেকেরই সন্তান এখন সুশিক্ষিত হয়ে উঠছে। তার সনদের সাথে তার বাবা মায়ের এনআইডি, জন্মনিবন্ধনের অনেক কিছুই মিল নেই। আর এখন নতুন করে অনেকের সমস্যা অনলাইন জন্মনিবন্ধন।
অনলাইন জন্মনিবন্ধন ছাড়া তার কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিক আইডির কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকের জন্মনিবন্ধন অনলাইন করা নেই। কিন্তু জন্মনিবন্ধন অনলাইন করেই ইউনিক আইডি তৈরির কথা বলা হয়েছে। এখন এ কাজটি করতে গিয়ে মেম্বার, চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা , সিটি কর্পোরেশন দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ। আর দেশের অনেক জায়গায় ইউপি নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে এ কাজগুলো করতে গিয়ে তারা সহজভাবে করতে পারছে না এবং তার পড়াশুনার ক্ষতিও হচ্ছে। আর যার অনলাইন জন্মনিবন্ধনে ভুল আছে তার তো ভোগান্তির শেষ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইন জন্মনিবন্ধনে ভুল কেন? জন্মনিবন্ধন এক সময় ম্যানুয়েল ভিত্তিতে ইউপি, পৌরসভা বা সিটিকর্পোরেশনে নিবন্ধিত হতো এবং সেখানেই রেকর্ড থাকতো। পরে সেগুলো অনলাইন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার অপারেটরা অনলাইনে পোস্টিং দেবার ক্ষেত্রে অনেকটা ঠিক শুদ্ধ করে পোস্টিং দেয়নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। পরে অনলাইনে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ জন্মনিবন্ধন ভুল বানানে ও ভুল জন্ম সালে পরিপূর্ণ। অথচ দেখা যায় ম্যানুয়েল জন্ম সনদে শুদ্ধই আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ভুলের জন্য ব্যক্তি মোটেও দায়ী নয়। কোন একজন ব্যক্তির সর্াটিফিকেটে ভুল থাকলে তার সবগুলোতে একই ধরনের শুদ্ধতা আনতে হয়। তার সাথে এখন একই ভাবে জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয় পত্রেরও সামঞ্জস্য থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন সময়ে তা না করে যদি যেনতেন উপায়ে ছাত্রছাত্রীদের ইউনিক আইডি তৈরির নামে তাকে আরও ভুলের দিকে ঠেলে দিই, তাহলে সে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। একটি ভুল পরবর্তীতে আরও ভুলের জন্ম দেয়। এখন সংশোধনের সুযোগ যে নেই তা না, কিন্তু প্রক্রিয়া মোটেও সহজ না। পদে পদে নানা ভোগান্তি। শুধু সংশোধন করার সহজ একটি পদ্ধতি সময় দিয়ে করা যেতে পারে, এই সময়ে যত ভুলভ্রান্তি আছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে সংশোধন করে নেয়ার জন্য। এটার জন্য আলাদা লোকবল দিয়ে বিশেষভাবে কাজটি করা যেতে পারে, যাতে অধিকাংশ হলেও সঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তা না করে ছাত্রছাত্রীদের ইউনিক আইডি তৈরির কার্যক্রম করলে তা আরও নানা ভুলের সমাহারে আইডি তৈরি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণ মানুষ অন্যের ভুলের মাশুল দিচ্ছে চরমভাবে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সেদিন সিএনজিতে চড়তে গিয়ে একজন সিএনজি চালকের কথা শুনে তার মর্মার্থটাই বুঝলাম। সিএনজি চালক বললেন, ‘স্যার আমি আমার ছেলেকে পড়ালেখা করাতে চাই। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছে না। কারণ আমার ছেলের জন্মনিবন্ধনে যে ভুল তার আমার ভুলে নয়। কারা করছে জানি না। কিন্তু এ ভুল সংশোধন করতে গিয়ে আমি নানা হয়রানির শিকার। একদিন গাড়ি না চালালে আমার পরিবার চলে না। আমি গাড়ি চালাব? না এগুলো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবো?’ তার এ মর্মবেদনার কথাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেশের অনেক মানুষেরই মর্মবেদনা। একটি দেশের নাগরিকদের এ হয়রানি থেকে মুক্তি দেবার জন্য এ নিয়ে অবশ্যই একটি সুচিন্তিত চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক,
বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিজিটাল হবার একি বিড়ম্বনা!
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে