বিলুপ্তির পথে চিরায়ত গ্রামীণ ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস

পুতুল নাচ

বাসুদেব খাস্তগীর | শনিবার , ২৫ মে, ২০২৪ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

পুতুল নাচ গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। গানের তালে তালে ঐতিহ্য এবং কাহিনির সাথে বাদ্যযন্ত্র ও সুরের মূর্ছনায় পুতুলের নৃত্য হয়ে ওঠে এক ধরনের মনের খোরাক। আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার এই জনপদ ঘিরে রয়েছে অনেক ঐতিহ্য। এই আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য বাঙালির একান্ত নিজের। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় সেই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়তারপর সেই সংস্কৃতি সেই জনপদে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। এই সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাঙালির হাজার বছরের এই জনপদে এভাবে গড়ে উঠেছে নানা সংস্কৃতি। আজকাল গ্রামের এইসব সংস্কৃতির অনেক কিছুই আজ বিলুপ্তির পথে। নগর জীবনে বেড়ে ওঠা অনেক শিশুকিশোররা ভাবতেই পারে না এ রকম কিছু ঐতিহ্য আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়ও ছিল। পুতুল খেলা শিশুদের কাছে উৎসবের মতো। মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে এ যেন গ্রাম বাংলার সাধারণ রূপ। আর তার সাথে যদি সেই জড় পুতুল নাচে, কথা বলে তাহলে ছোট থেকে বড় সবাই যেন তা আনন্দের সাথে অনুভব করে। বাংলার সংস্কৃতিতে বিনোদনের বড় মাধ্যম এটি। রাত জেগে পুতুল নাচ দেখতে গ্রামীণ মানুষ ভিড় করতো এই পুতুল নাচের আসরে। একসময় গ্রামীণ জনপদে শিশুকিশোরসহ ও সকল মানুষের বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে পুতুল নাচ ছিল অসম্ভব জনপ্রিয় একটি খেলা। আমাদের শিশুকিশোরদের জীবনে শৈশবে পুতুল একটি প্রধান অনুষঙ্গ। গ্রামীণ কিংবা শহর যে কোনো জনপদই হোক না কেন ছোটবেলার শিশুদের খেলার অনুষঙ্গ হিসাবে শিশুর পিতামাতা শিশুর হাতে পুতুল তুলে দেন। মেলায় গেলে শিশুকে পুতুল কিনে দিতেই হবেএটা অপরিহার্য একটি বিষয়। সেই পুতুল তুলে দেয়ার যে সংস্কৃতি তা এখনো সমাজে বিদ্যমান আছে। পুতুল পেয়ে শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে। কার না শৈশব পুতুল ছাড়া কেটেছে বলেন তো? তা ছেলে হোক বা মেয়ে হউক। সেই পুতুল নিয়ে শৈশবে কত ধরনের খেলায় না মেতেছে। ভাই বোনের মধ্যে বা আশেপাশের পরিবারের শিশুরা পুতুল নিয়ে খেলায় মেতে থাকতো। পুতুলদের নিয়ে বর কনে সাজিয়ে বিয়ে দেয়া হতো, নিমন্ত্রণ দেয়া হতো। সেইসব দিনগুলো ভাবলেই অনেকেই নস্টালজিয়ায় ফিরে যান। সেই পুতুল নিয়ে কত কবি ছড়াকার কবিতা ছড়া লিখেছেন কিংবা গান লিখেছেন তার সংখ্যা অসংখ্য। আমাদের পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন তাঁর কবর কবিতায় লিখেছেন, ‘পুতুল বিয়ে ভেঙে গেলো বলে কেঁদে ভাসাইত বুক, কিংবা মান্না দে কণ্ঠে গাওয়া পুলক বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে।’ এভাবে পুতুল হয়ে উঠেছে আমাদের শিল্পসাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি ক্ল্যাসিক উপন্যাস। সে উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা প্রসঙ্গে বিজ্ঞানমনষ্ক এ ঔপন্যাসিক বলেছিলেন, ‘সত্যই তো আর পুতুল নয় মানুষ। অদৃশ্য শক্তি বা অন্য মানুষের আঙুলে বাঁধা সুতোর টানে সত্যই তো মানুষ পুতুলের মত নাচে না।’ তিনি যখন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নামে উপন্যাস লিখলেন সেখানে প্রশ্ন আসতেই পারে এই পুতুলের নাচানোর মত অদৃশ্য দড়ি কার হাতে ছিল? আসলে পুতুলের কোনো শক্তি নেই, মানুষ তাকে কল্পনায় নানাভাবে তুলে ধরে। তার পিছনে এক অদৃশ্য সুতোয় নাচিয়ে নানা সামাজিক চিত্রে মানুষের চরিত্রকে তুলে আনে। আব্বাসউদ্দীনের একটি বিখ্যাত গানে পুতুল এসেছে এভাবে ‘ছায়াবাজী পুতুল রূপে বানাইয়া মানুষ, যেমনি নাচাও, তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ।’ পুতুলের কোনো শক্তি নেই, মানুষের এক অদৃশ্য সুতোর টানে পুতুল নাচে। সেই অদৃশ্য সুতোর টানে সমাজের অসংগতি ও গ্রামের মোড়লদের চরিত্র নানা উপমায় ব্যবহার হয়েছে। সেই পুতুল নাচ দেখানোকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির পেশাদারি দল সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী সময়ে। শিশুদের সাথে পুতুলের এই সংশ্রবের ইতিহাস কিন্তু মানব সভ্যতার সৃষ্টির সাথে সাথেই। পুতুলের মায়াবী চাহনির সাথে দোলনায় দোল খেতে খেতে ঘুমপাড়ানিয়া গান শুনে শুনে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তো। সেই হাজার বছরের ঐতিহ্য অনেকটা ম্লান হয়েছে প্রযুক্তির কারণে। পুতুল এখনো শিশুর কাছে জনপ্রিয় কিন্তু সেই পুতুলকে ঘিরে পুতুল নাচ গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে একেবারে হারিয়ে যাবারই পথে। পুতুল শিশুদের কাছে সবসময় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বলেই শিশুদের মনোজগতকে কেন্দ্র করেই পুতুল নাচের সৃষ্টি। শিল্প সাহিত্য গান নাটক চলচ্চিত্রে পুতুল কত ভাবেই না এসেছে। মান্না দে গেয়েছেন ‘আমি মানুষ চেয়েই করেছিলাম ভুল তুমি ছিলে শুধু রং করা পুতুল।’ চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি নায়ক নায়ক নায়িকার শৈশবে কত দারুণভাবে পুতুল খেলা উঠে এসেছে। কুমার বিশ্বজিতের গান ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে।’ এখানে পুতুলকে রোমান্টিকতায় টেনে আনা হয়েছে। পুতুল নাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যম। বাংলাদেশে পুতুল নাচের যে ঐতিহ্য রয়েছে তাতে দেখা যায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে শিবিরে পুতুল নাচের মাধ্যমে সেই সময়কার পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরা হতো। সুতরাং পুতুল নাচ আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধেরও অনন্য অংশীদার। বলা হয় ইউরোপের পুতুল নাচের সবচেয়ে প্রাচীনতম দেশ জার্মানি। এই জার্মানদের হাত ধরেই পুতুল নাচ উন্নত বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারা পুতুল নাচের মাধ্যমে পৌরাণিক ও রূপকথার কাহিনি তুলে ধরত। বাংলাদেশেও পুতুল নাচের হাজার বছরের যে ইতিহাস তাতে দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন শুরু হয়। তারাই কাপড়, কাঠ, পাট, শোলা দিয়ে পুতুল আধুনিক আঙ্গিকে তৈরি করে। পরে দেশব্যাপী এর বিস্তৃতি ঘটে। আজকাল শিশুরা নানা ধরনের কার্টুন নির্ভর টিভি সিরিয়ালের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিষয়টি অবশ্যই বেদনাদায়ক। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা অনেকে অনেক কিছুই হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছি সত্য, কিন্তু তারা নির্জীব জীবনাসক্তের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ সবের প্রতি আসক্তি শিশুদের সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। পুতুল নাচ নিয়ে গত ২৩ নভেম্বর ২০২২ সালে একাত্তর টিভিতে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে দেখানো হয় ‘মনিকা পুতুল নাচ ও থিয়েটার’ দলের জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পুতুল নাচের দৃশ্যায়ন। সেখান থেকে বের হয়ে অনেক তরুণ তরুণীকে বলতে দেখা যায় নিয়মিত পুতুল নাচের সংস্কৃতি চালু করলে প্রযুক্তির এ যুগে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির দাপট অনেকখানি কমবে। এখানে প্রায় ১০টির মত পুতুল নাচ দলের মধ্যে মাত্র ১টি ‘মনিকা পুতুল নাচ ও থিয়েটার’ সবেধন নীলমণি হয়ে টিকে আছে। পুতুল নাচের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই এখন দিনমজুরী করে দিন যাপন করছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক জানান মনিকা পুতুল নাচ ও থিযেটার দলের দুইজন সদস্যকে সরকারি ভাতার আওতায় আনা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অন্যদেরকেও আনা হবে। পুতুল নাচের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এটি একটি আশাপ্রদ খবর। প্রতিবেদনে বলা হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ১৯৮৭ সালে মনিকা পুতুল নাচ ও থিয়েটার দলকে নিবন্ধিত করা হয়। এক ফুল দুই মালী, কাসেম মালার প্রেম, রাম বনবাস, রাজা হরিশ্চন্দ্র, রাবন বধ, সাবিত্রী সত্যবান, সাগর ভাসা নামের ও আরো অনেক পুতুল নাচ মনিকা পুতুল নাচ ও থিয়েটার দলে এখনো আছে। মাঝে মাঝে নাকি শিল্পকলা একাডেমিতে এ দলের ডাক পড়ে। এটি দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবেদন। এই কার্যক্রম দেশের সর্বত্র এভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে পুতুল নাচ আবার সগৌরবে ফিরে আসবে ধীরে ধীরে। পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখদুঃখ, রঙ্গরস, হাসিঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরি করে, সেটাতে রং তুলির পরশ দিয়ে সাজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাচানো হতো পুতুল নাচের আসরে। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এই শতকে পুতুলের কদর তেমন নেই। প্লাস্টিকের আক্রমণে মাটির তৈরি সাংসারিক জিনিসপত্র উঠে যাবার পাশাপাশি উঠে যাচ্ছে মাটির তৈরি পুতুলও। আমাদের শিশুকে সৃজনশীল ও মননশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই চাই আমাদের ঐতিহ্যগত দিকগুলোর বিশেষ প্রয়োগ। পুতুল নাচ শিশুদের জন্য হতে পারে সৃজনশীল ও মননশীলতার অন্যতম উপাদান।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিভাবকদের অসচেতনতায় কিশোর অপরাধ বাড়ছে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে