দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ডিনার শেষে যথারীতি আড্ডা চলছিল। গোলাকার টেবিলে বসে আড্ডা। সবাই সবাইকে একেবারে সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এতে গল্পের আমেজ এবং আবহ দুটোই বেড়ে গিয়েছিল। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে আড্ডা দেয়াটা আমাদের বেড়ানোর সময়কার প্রাত্যহিক আয়োজন। প্রতিরাতেই ডিনার শেষে আমাদের জমজমাট আড্ডা চলে। কখনো খাওয়ার টেবিলে, কখনোবা লবিতে। এই আাড্ডা শুধু সময় কাটানোই নয়, নিজেদের চাঙ্গা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতারও বিনিময় ঘটে। শেখা যায় অনেককিছু। এতে করে ডিনারোত্তর এই আড্ডা আমাদের নবীনদের জন্য বেশ বড় একটি আকর্ষনের বিষয়। কত কিছু যে জানা যায়! কত বিষয়ে যে আলোচনা হয়! লায়নিজমের সফরগুলোতে সমমনা মানুষগুলো প্রাত্যহিক এই আড্ডাকে প্রানবন্ত করতে কৃপণতা করেন না। অভিজ্ঞতার ঝুড়ি উপড়ে দেন। খাওয়া দাওয়া শেষে স্বাভাবিকভাবে রুমে ফেরার কথা থাকলেও আমার প্রিয় এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বসে যান আড্ডায়। ম্যাডাম অতি আবশ্যকীয়ভাবে সাথী হন। সাবেক গভর্নর লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া কিংবা অন্যান্য প্রবীন লায়ন সদস্যরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। আমরাও টুকটাক বলি। তবে আমরা বলার চেয়ে শুনি বেশি। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে বাড়তি কিছু জানার থাকলে জেনে নিই। আমাদের এবারকার দলটি তুলনামুলকভাবে ছোট। লায়নের দলগুলো সচরাচর অনেক বড় হয়। অনেক মানুষ থাকেন। এবার আমরা একেবারে ঘরোয়া একটি দল বের হয়েছি ভারতের উত্তর দক্ষিন চষে ফেলতে। দল ছোট হওয়ায় আড্ডার পরিসর ছোট হয়েছে, তবে ধরণ পাল্টায়নি। প্রতিরাতে আমরা আড্ডায় বসি, প্রতিরাতেই আমরা গল্প করি। নানা ধরনের গল্পের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ করি, চাঙ্গা করি। বেশ রাত করে আমরা রুমে ফিরি, ঘুমুতে যাই।
কিন্তু আজ খাওয়ার টেবিলে বেশিক্ষণ না বসে স্যার বললেন, ‘চলো, কফি খেয়ে আসি।’ দুনিয়াতে আমার কোন নেশা নেই। পান সিগারেট গাঁজা মদ থেকে শুরু করে আধুনিক জগতের নাম না জানা বহু ধরনের মাদকের সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও নেই। তবে চা এবং কফির প্রতি আমার আকর্ষণ দুর্বার। আমার ঘরনির অভিযোগ, চায়ের নামে কেউ আমাকে গরম পানি দিলেও আমি নাকি খেয়ে নেবো। অবশ্য কফির জন্য আমার আকর্ষন আরো একটু তীব্র। কফির কথা শুনলেই আমার অন্তর নেচে উঠে। কফির ঘ্রাণ আমাকে মহুয়া ফুলের ঘ্রাণের মতো টানে! ধুমায়িত কফিতে চুমুক দেয়ার কি যে আনন্দ!
আমাদের দলের কেউ কেউ কফি খাবেন না বলে জানালেন। কিন্তু সাথে যেতে আপত্তি করলেন না। এটিই নিয়ম, কফি খান বা নাখান তাতে কিছু যায় আসে না, সাথে এসেছি, সাথে ঘুরছি এটাই বড় কিছু। এটাই ঘোরাঘুরির অলিখিত নিয়ম। আমরা সবাই মিলেই রাস্তায় নামলাম। একটু হাঁটাহাঁটি করে কফি খেতে যাবো, এটাতে আলাদা একটি আনন্দ আছে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ডিনার শেষে চমৎকার রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কফিশপ খুঁজে নিই, কফি খেয়ে আবারো দলবেঁধে রুমে ফিরে আসি। কখনো কখনো ঘুরপথও ধরি, ইচ্ছে করেই।
কলকাতার রাস্তা ইউরোপ আমেরিকার মতো সুন্দর নয়, অত ফাঁকাও নয়। ইউরোপ আমেরিকার রাস্তাগুলো ফাঁকা, লোক চলাচল কম। রাস্তায় যে কয়েকজনের দেখা মিলে তারা এমনভাবে দৌড়ায় যে কখন যে কোথায় গায়েব হয়ে যায় কে জানে! আমাদের মতো আয়েশি ভাব নিয়ে হাঁটার সময় তাদের নেই। ইউরোপের সব শহরই ফাঁকা ফাঁকা নয়, কিছু কিছু শহরের রাস্তায় প্রচুর মানুষ থাকে। তবে ধাক্কাধাক্কি করে হাঁটার শহর ইউরোপ আমেরিকায় খুব বেশি নেই। বিস্তৃত ফুটপাত ধরে আরামে হাঁটা যায়। আয়েশ করে পথ চলতে কোন অসুবিধা হয় না। কলকাতা শহরে ইউরোপের আমেজ পাওয়ার কোন কারন নেই। তবুও ইউরোপ আমেরিকার শহরগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে সামনে হাঁটছিলাম। হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয় থেকে বের হতেই রাস্তায় প্রচুর মানুষ। কলকাতার নিউমার্কেট সন্নিহিত এই এলাকাটিতে কি পরিমান মানুষ যে গিজগিজ করে তা লিখে বুঝানো কঠিন! আমরা ভীড়ভাট্টা ঠেলে সামনে এগুলাম। ফুটপাত ধরে ব্যবসা করছে মানুষ। জমজমাট বিকিকিনি। বিভিন্ন দেশে নাইট মার্কেট দেখেছি। সন্ধ্যার পর বাজার জমে উঠে, চলে গভীর রাত অব্দি। কলকাতার এই এলাকায় ডে-নাইট সমানতালে মার্কেট চলে। সারাদিনই গিজগিজ করে মানুষ। কত ধরনের মানুষ যে কত ধরণের পণ্যের পসরা সাজিয়ে রাস্তায় বসে আছেন! কত ধরনের মানুষ যে কেনাকাটা করছেন। গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ, দেশি মানুষ, বিদেশী মানুষ সব হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সব ধরনের জিনিসই বিক্রি হয় জায়গাটিতে। এক কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা জুড়ে বিস্তৃত বাজার। রাস্তার একপাশে সব অভিজাত দোকান, অন্যপাশ জুড়ে হকার। কোথাও কোথাও রাস্তার দুই পাশই হকারের দখলে। ফুটপাত-রাস্তা সবই একাকার। গাড়ি চলাচলের জন্য সামাণ্য ফাঁকা রেখে বেশ চওড়া রাস্তাটির পুরোটাই জুড়ে চলে বিকিকিনি।
কি নেই সেখানে, সবই পাওয়া যায়। পুচকা চটপটি, পানি পুরী থেকে শুরু করে শার্ট প্যান্ট ব্লেজার, শাড়ি, চুড়ি, লিপস্টিক, কসমেটিকস, গয়না, খেলনা সবই জুটে যায় অনায়াসে। নানা পণ্য কিনে ব্যাগে ভরবেন? ব্যাগ নেই? সমস্যাও নেই। হাত বাড়ালে বিভিন্ন সাইজের ব্যাগ, ট্রলি ব্যাগ সবই জুটে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া বেশি করেছেন? ওজন মাপতে হবে। জ্বী, ওজন মাপার মেশিন নিয়ে মানুষ বসে আছে। সিগারেট টানবেন? তাও আছে। মদ বিয়ার নেই মনে করছেন? অনায়াসে জুটে যাবে! হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়েছেন? বরফকুচি দেয়া জুস খাবেন? টেনশনের কিছু নেই। ওই তো মেশিনপত্র নিয়ে লোক বসে আছে। জিরা পানি, সোডা, ঠাণ্ডা পানীয়! সবই আছে। সবই বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়, ফুটপাতে। স্ট্রিট ফুডের দারুণ জয়জয়কার কলকাতার এই জায়গাটিতে।
আমরা হাঁটছিলাম। হেলে-দুলে। কোন কিছুর তাড়া নেই, কোনকিছু কেনার নেই। কফি খাওয়া ছাড়া বাড়তি কোন লক্ষ্যও নেই। কফি শপে গিয়ে আমরা অর্ডার করলাম। যারা খাবেন না বলেছিলেন এখন তারাও খালি একটি কাফ চেয়ে নিয়ে দু’জনে শেয়ার করছিলেন। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ ভালোই বানিয়েছে কফি! স্যার এমনভাবে বললেন, যেন আমি কফি বিশেষজ্ঞ। আমিও মাথা নাড়লাম। দারুণ হয়েছে। ধোঁয়া উড়ছে। উড়ছে কফির ঘ্রান। এই ঘ্রাণ আমাকে মাতোয়ারা করে!
সকালে ঘুম ভাঙলো স্যারের ফোনে। ইন্টারকমে না করে স্যার সরাসরি ফোন করেছেন মোবাইলে। স্যারের ফোনে ঘুম ভাঙ্গাটা নতুন নয়, পুরানো ঘটনা। দেশেও প্রায়শ সকালে স্যার ফোন করেন, নিউজের খবরাখবর নেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। এখন অবশ্য নিউজের জন্য নয়, নিউজ থেকে বহুদূরে রয়েছি আমরা। বললেন, ‘নাস্তা করতে যাবো, সবাইকে ফোনে বলে দাও। আর রেস্টুরেন্টে ভিড় কেমন খবরও নিও।’ স্যার তো এত ভোরে নাস্তা করেন না, কয়টা বাজে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমমুম ভাব উবে গেল। যদিও আমার তেমন কোন কাজ নেই, তবুও সকাল নয়টা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি ভাবতেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো।
আসলে দোষ তো ঘুমের নয়, শরীরের। এই এক শরীর আর কত ধকল সামলাবে! শান্তিনিকেতন যাওয়া-আসার দীর্ঘ জার্ণি এবং দিনভর নানাস্থানে ঘোরাঘুরি করে রবি ঠাকুরের স্মৃতি হাতড়ানোতে আনন্দের পাশাপাশি বিস্তর ছোটাছুটিও ছিল। এই ছোটাছুটি শুধু আনন্দই নয়, ক্লান্তিও দিয়েছে। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে বেজায় খাওয়া দাওয়া এবং বেশ রাত অব্দি আড্ডা শেষে যখন ঘুমিয়েছি তখন শরীর আর নিজের কাছে ছিল না। এত ধকলের পর ওই শরীরের কাছ থেকে ভোরে ঘুম ভাঙ্গার আশা করা কঠিন। তাই একেবারে বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলাম। কখন যে সকাল নয়টা বেজে গেছে টের পাইনি। স্যার ফোন না করলে এই ঘুম যে কবে ভাঙ্গতো তাও অজানা। ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে ফোন করলাম। আমাদের জন্য টেবিল রাখতে বললাম। ফিরতি উত্তর পেলাম যে, ‘সমস্যা নেই। চলে আসুন। ফাঁকা আছে।’ আমি যথারীতি সবাইকে ফোন করে রেস্টুরেন্টে নামতে বললাম।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ স্বস্তি পেলাম। বিশাল রেস্টুরেন্ট, তবে লোকজনের তেমন ভিড় নেই। জানালার পাশের একটি টেবিলে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সুইমিং পুল। পুলে সাঁতার কাটছেন তিন পশ্চিমা নারী পুরুষ। রাজহাঁসের মতো ভাসছে তারা, জলকেলি করছে। আড়চোখে দেখছিলাম তাদের। তাদের আনন্দ আমাকেও পুলকিত করছে, আনন্দিত করছে। নানা স্বাদের নানা খাবারে চলছিল আমাদের রাজকীয় ব্রেকফাস্ট। কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার লাগছিল পরিবেশ। কাঁচটি বাদ দিলে মনে হচ্ছিল পুলের পাড়ে বসে নাস্তা সারছি। এমন নান্দনিক এক পরিবেশে নাস্তা করার তৃপ্তিটা আসলেই অন্যরকম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিড়ম্বনার আরেক নাম এনআইডি ও জন্মনিবন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর