আধুনিক জীবনের আরাম এবং সহজতর প্রাত্যহিক জীবনের হাত ধরে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কয়েক দশক ধরে তাপমাত্রার পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের ধারা পাল্টে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত উষ্ণতম দিনগুলোর স্থায়িত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী গরমের তাণ্ডব চিন্তিত করে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। শীতপ্রধান দেশেও সকল সময়ের রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি চিন্তার বিষয় বটে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট–রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট–রক) সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। প্রথমবারের মত ঢাকা উত্তরে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে একজন হিট অফিসারের। এর আগে ২০২১ সালে আর্শট–রক তাদের কাজের অংশ হিসেবে প্রথম হিট অফিসার নিয়োগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামি শহরে জেন গিলবার্টকে প্রথম হিট অফিসারের নিয়োগ দেয়া হয়। তাপপ্রবাহে স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক যে ঝুঁকি তা নিয়েই মূলত কাজ ছিল তাঁর। সারাবিশ্বে বিভিন্ন শহরে এ–পর্যন্ত আটজন নারীকে হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে আর্শট–রক। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এই অফিসাররা নিজ নিজ শহরে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিত উদ্যোগে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, লস অ্যাঞ্জেলেস, চিলির সান্টিয়াগো, সিয়েরা লিওনের সান্টিয়াগো, গ্রিসের এথেন্স, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছে। সবশেষ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নিয়োগ প্রাপ্ত হন বুশরা আফরিন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম এক দূষিত শহর। অতিরিক্ত তাপমাত্রা খুবই দুর্বল অবকাঠামোর এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে ক্রমশ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, শৃখলাহীন পরিবহন ব্যবস্থা, সবুজহীন কংক্রিটের এই শহরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ন্ত এই তাপমাত্রাকে মোকাবিলা করা হচ্ছে শীতাতপযন্ত্র দিয়ে যা বুমেরাং হয়ে মহানগরকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত করেছে। লক্ষ লক্ষ শীতাতপ যন্ত্র বিশ্ব উষ্ণায়নের এক নতুন অনুষঙ্গ।
ঢাকা মহানগরীর এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য একজন হিট অফিসার নিয়োগ নিঃসন্দেহে আশা জাগানিয়া। তাপমাত্রা যে বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটাই এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই নিয়োগ ঢাকা উত্তরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ হবে বলে আশা করা যায়।
তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলা এবং নগরে ‘হিট আইল্যান্ডে’র প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করাই চিফ হিট অফিসারের কাজ। বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তি, নাগরিক সমাজ, দাতাসংস্থাসহ সব পক্ষকে সম্পৃক্ত এবং সমন্বয় করার দায়িত্বও চিফ হিট অফিসারের।
অন্যদিকে এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যম। মহানগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে, কংক্রিট বেইজড নগর অবকাঠামো তৈরি করে নগরকে উত্তপ্ত করার সিদ্ধান্তই মূলত জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। সিদ্ধান্তের মূল জায়গায় কাজ না করে হিট অফিসার নিয়োগ কতখানি কার্যকর তাই প্রশ্ন তোলে নেটিজেনরা। এছাড়া বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কন্যা হওয়াতে বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে উঠে, সাথে একজন নারীকে হিট অফিসার নিয়োগ দেয়াতে সামাজিক মাধ্যমে তাকে অনেক হেনস্তার শিকারও হতে হয়।
বুশরা আফরিন নিজস্ব যোগ্যতায় আর্শট–রক এর নিয়োগ প্রাপ্ত অফিসার, যিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের উপর পড়াশোনা করেছেন, কাজ করেছেন বেসরকারি সংস্থায়। বুশরা নগরের তাপমাত্রা নিয়ে কাজ করা প্রসঙ্গে বলেন, তাপপ্রবাহের ফলে যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তা নিয়ে কাজ করবেন। জনগণকে সচেতন করাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেন সচেতনতা প্রতিরোধের প্রথম কাজ। নারী, শিশু, বৃদ্ধদের তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষায় তিনি কাজ করবেন। এছাড়াও তাপ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে সংগৃহীত ব্যবস্থা যেমন কুলিং পেইভমেন্ট, কুল রুফ, শহর ভিত্তিক বনায়নের ব্যাপারে জোর দেন বুশরা আফরিন। কারিগরি কিংবা প্রকৃতি নির্ভর বা উভয়ের সমন্বয় কোনটা আমাদের জন্য ভালো হবে সেটা বের করে সেভাবেই কাজ করতে চান তিনি। তবে প্রকৃতি নির্ভর কাজকে তিনি এগিয়ে রাখছেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে দুই বছরে দুই লক্ষ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
আর্শট–রক এর অর্থায়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা দেশের প্রথম হিট অফিসার বুশরা আফরিন নগরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আশাব্যঞ্জক কাজ করবেন বলে সুধিজন মনে করেন এবং লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখার অপেক্ষায় আছেন সাধারণ জনগণ।