রাবুর দিনলিপি

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৩ মে, ২০২৩ at ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

বছর চারেক আগের কথা। বৈশাখের কোন এক শুক্রবার। রাবেয়া বেগম প্রথমবারের মতো বিপণী বিতান ‘আড়ং’ দেখেন। নিজের হাতে ধরেবেছে শাড়ি কেনেন, এই প্রথম। এতো বড় মিলনায়তনে একসঙ্গে এতো কিছুশাড়ি, গহনা থেকে হাঁড়িকুঁড়ি, থালাবাসন, ঘর সাজাবার সামগ্রীসব থরে থরে সাজানো। এই শহরে এমন দোকান আগে কোনদিন দেখেননি তিনি। সত্যি বলতে কি, দোকানেই যাওয়া হয়নি তাঁর। প্রথম প্রথম কর্তা তাঁর পছন্দমতো নিয়ে আসতেন। মেয়েরা বড় হলে ওরাই আনতে শুরু করে, যখন যা লাগে। ছেলেরা বড় হলে ওরাও নিয়ে আসে এটা সেটা। বড় দুই ছেলের জন্য বউ আনা হয়েছে। ওরাও কিনতে শুরু করে মায়ের জন্য শাড়ি হাঁড়িআরও কত কি!

এতগুলো বছর চট্টগ্রামে! তিন তিনটি দশক পার হয়ে গেল, শহরের অদূরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থায়ী নিবাস; ছেলেমেয়েদের বাবার কর্মসূত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিসীমানায় কোন বিপণী বিতান ছিল না সেকালে। এখনও তেমন নেই বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাঁদের পরিবার পরিজনের কেনাকাটার সুবিধের জন্য প্রতিদিন তাই বাস যায় শহরে। শিক্ষক পত্নীগণের কেউ কেউ প্রায় প্রতিদিনই ভ্রমণ করেন সেই গাড়িতে। অনেকে যান দু’চারদিন পরপর। মাসে একাধিকবার যান অনেকে। রাত আটটা নটা নাগাদ বাড়ি ফেরেন সবাই হাতভরা বাজার আর মুখভরা হাসি নিয়ে। অথচ রাবেয়া বেগমের এমন অনেক বছর গেছে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে একবারও ঐ গাড়িতে চড়েননি। ডাক্তার বাড়ি কিংবা জরুরি সামাজিক প্রয়োজনে আত্মীয় বাড়ি যাওয়া হতো কালেভদ্রে। কেনাকাটাকাঁচা বাজার, শুকনো বাজার তো নয়ই, শাড়িগহনা, হাঁড়িপাতিল, ঘর সাজাবার সামগ্রীও নিজে দেখেশুনে কেনা হয়নি তাঁর। কেউ তাঁকে আটকে রেখেছে, তা কিন্তু নয়। ঘরে বসেই প্রয়োজনীয় সবকিছু হাতের নাগালে পেয়ে যান। আর কিছু চাইবার নেই তাঁর।

দোকানের ত্রিসীমানায় না গিয়েও রাবেয়া বেগমের ঘরে এখন শাড়ির পাহাড়। পরার সময় হয় না। বিলিয়ে দেন দুই হাতে। তবু ফুরোয়না। ইচ্ছে করলেও সব বিলিয়ে দিতে পারেন না। মা শ্বাশুড়ির দিনের শাড়ি থেকে শুরু করে হালের আড়ং দেশি দশের সংগ্রহ তাঁর। সব কিছুতেই মিশে আছে অনেক গল্প, অনেক স্মৃতি। আলমারির ডালা দুটো মেলে দিলেই কথা কয়ে ওঠে ইতিহাস।

নানাসাহেব তাকে আদর করে ডাকতেন রাবু। জন্ম থেকে নানাবাড়িতে বসবাস রাবুদের। বিপত্নীক নানা তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চোখের আড়াল করেননি। সেই সুবাদে বড় দুই ভাই সহ নানাবাড়িতেই বেড়ে ওঠা রাবুদের। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় মাকে হারায় রাবু। দু’বছরের মাথায় নানাসাহেবও চলে যান না ফেরার দেশে। এরপর আসে রক্তাক্ত একাত্তর। হারিয়ে যায় রাবুর তরতাজা ভাইদের একজন। কৈশোর থেকে এভাবে মৃত্যু দেখতে দেখতেই বড় হয় রাবু। মামামামির আদরের কমতি ছিলনা কোনদিন। মামাতো বোনদের সাথে একপাতে খেয়ে মানুষ হয় রাবু। যদিও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে ছিল না সব সময়। অসহায় বলে করুণা করত কেউ কেউ। বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করত না অনেকে। ঠিক যেন রূপকথার সিনডারেলা।

একদিন এলো এক রাজার কুমার। না, ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো’রূপকথার সেই সহজ সমাপ্তি দিয়ে শেষ করা যাবেনা রাবুর গল্প।

মাধ্যমিকের সনদ হাতে নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে নাম লেখাতে না লেখাতেই সোনাপুর গ্রাম ছাড়তে হয় রাবুকে। গন্তব্য মেঘনা পাড়ের এক গ্রাম। ঘরকন্নায় অপটু। বড়বাড়ির বড় ঘরে টিকে গিয়েছিল, কোন যাদুমন্ত্রবলে নয়। নিতান্ত সাদাসিধে এক মেয়ে। সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী এই গুণগুলো ঠিক যায় না তার সঙ্গে। ধৈর্য, স্থিরতা, সহনশীলতাই তার ভূষণ, তার বর্ম। পড়ন্ত বেলায় এসে তাঁর উপলব্ধি– “নীরবতাই আমার শক্তি, নীরবতাই আমার অস্ত্র”। জীবনের বাঁকে বাঁকে পরিবারের বাইরে তেমন কোন বন্ধুলাভ হয়নি। সখ্য কেবল বইয়ের সঙ্গে। বাড়িতে বিদ্যুৎ আসার আগে মশারির ভেতর হারিকেন নিয়ে বই পড়তে গিয়ে মরার দশাও হয়েছিল। সেই নেশা আজও ছাড়েনি।

একান্নবর্তী পরিবারে ষোল বছর কাটানোর পর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খাতিরে রাবেয়া বেগমকে পাড়ি দিতে হয়েছিল চট্টগ্রামে। কতো কী যে দেখার আছে এই শহরে! পাহাড়, সাগর, অরণ্য, রঙমহল, বিপনীবিতান। কিছুই দেখা হয়নি তাঁর। এনিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ অনুযোগ নেই। তিল তিল করে ইটের পর ইট বসিয়ে নিজেদের জন্য একটা বাড়ী বানিয়েছেন তাঁর প্রাণের মানুষ, রাবুর ছেচল্লিশ বছরের জীবনসঙ্গী। কয়েক ঘর ভাড়াটিয়া আছেন প্রতিবেশীর মতো। সেই সূত্রে বাড়িওয়ালীও বলা যায় এখন তাকে। তবে নিজের বাড়ির ছাদে গিয়ে খোলা আকাশ দেখতে যাওয়ার সময় হয় না তাঁর। দোতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে গিয়ে গাছের ফলপাকড় আনাও হয় না। ছেলেমেয়েরা কেমন স্কুলে যায়, কোথায় যায়সেটাও দেখেননি কোনকালে। এমনই আলাভোলা তিনি। প্রার্থনা, ঘরকন্না আর স্নানহার শেষে ভাতঘুমের পালা এলে বালিশের পাশে রাখা নজরুল, রবীন্দ্র, শরৎ, মানিক, রোকেয়া, হুমায়ুনরা সঙ্গ দেন তাঁকে। দিনের বাকি সময়টা ওঁদের সঙ্গেই কাটে তাঁর।

শুধুই বেড়াতে যাবার জন্য বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। রাজধানীর বুকে প্রথম পা দিয়েছিলেন হজ্বে যাবার পথে। আল্লাহর ঘরে যাবেন, নবীর রওজা জেয়ারত করবেন এমন স্বপ্নও তিনি দেখেননি কোনকালে।

এর মধ্যে কতো কী যে ঘটে গেল! ছেলেমেয়েরা একে একে বাড়ি ছাড়ল। আকাশ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল অন্য গোলার্ধে। বাবার স্বপ্নকে ছুঁতে। তাঁর স্বপ্নে কখনও উচ্চাশা ছিলনা, আজও নেই। ছেলেমেয়েদের মুখের হাসিতেই তাঁর আনন্দ, ওদের সুস্থতাতেই তাঁর শান্তি, পরিতৃপ্তি। ওদের নিয়ে গর্বেও শেষ নেই তাঁর। এ গর্ব পার্থিব কোন সাফল্যের জন্য নয়। অনেকগুলো বছর ভিনদেশে কাটানোর পরও কোন চাকচিক্য, মোহ ওদের চোখে রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়নি। পৃথিবীর যেখানেই যাক হৃদয়ে ওদের বাংলাদেশ, বুকের ভেতর ‘ধীরে বহে মেঘনা’।

বলা নেই কওয়া নেই এই অতি সাধারণ রমণী জীবনসঙ্গীকে নিয়ে একদিন উড়ে যান অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। প্রশান্ত মহাসাগর বুঝি তাঁর পা ধুয়ে দিয়েই ধন্য হয়। কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের পাশ ঘেঁষে গ্রেট বেরিয়ার রিফ অতিক্রম করে পৌঁছে যান তিনি ক্যাপেলের দ্বীপে। তাঁর পায়ের ধুলো পড়ে মেলবোর্ন, সিডনী ও তাসমানিয়ার রাজপথে। এরপর বছর চারেকের মাথায় পাড়ি দেন সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেন নাগাসাকি শহরে। ঘুমন্ত ও জাগ্রত আগ্নেয়গিরি পরিদর্শন করেন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। চেরি ফুল ফোটার আগেই দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল বলে কষ্টের শেষ নেই দ্বিতীয় পুত্রের। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আরও একবার যান তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায়। বিদেশে গিয়েই একে একে ছেলেমেয়েদের স্কুল দেখেন; মেলবোর্ন, হোবার্ট, রখহ্যাম্পটন আর কুমোমতো শহরে। বিদেশের মাটিতেই প্রথম দেখা হয় তাঁর সুসজ্জিত আধুনিক বিপনীবিতান। কিন্তু সেখানে তো আর শাড়ি মেলেনি। মেলেনি মনের মতো কিছু। তেমন সাজানো দোকান বাংলাদেশে আছে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে, বড় মেয়ের বাসার এতো কাছে, তিনি ভাবেননি কোনদিন। সেদিন তাই ‘আড়ং’ এ ঢুকেই চমকে উঠেছেন রাবেয়া বেগম। প্রবেশদ্বারে বিমানবন্দরের মতো নিরাপত্তা রক্ষী, যন্ত্রপাতিএলাহি কাণ্ড। ভেতরে গিয়েও চমকের পর চমক। এ কোথায় এলাম! ঠিক যেন বিদেশ! ধরে ধরে দেখেন এটা ওটা। গায়ে লেখা দাম দেখে পিছিয়ে যান কয়েক পা। কাজ নেই এসব নিয়ে। অনেক অনুরোধের পর অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্যের অল্প কিছু জিনিস নিতে রাজি হন।

এই আমাদের ‘আম্মা’। আমার সঙ্গে দুই রাত্রি কাটিয়ে ফিরে যান তাঁর আপন ঠিকানায়, যেখানে একসময় গমগম করতো কতো মানুষ! দূরের কাছের আত্মীয় অনাত্মীয় ছাড়াও ছেলেমেয়েদের বন্ধুদের নিত্য আনাগোনা ছিল সেই বাড়িতে। এখন সেখানে পিনপতন নিস্তব্ধতা। অধ্যাপনা থেকে অবসরে যাবার পর আব্বা গ্রামে চলে যান প্রায়ই। স্বল্পভাষী ছোট ভাইটি আম্মার দেখভাল করে যত্নের সঙ্গে। কিন্তু আওয়াজ নেই সারা বাড়িতে। আজকাল মুঠোফোনটা অবশ্য তাঁর বেজায় ব্যস্তসমস্ত। সারাদিনই বাজে একটু পরপর। প্রশান্ত মহাসাগরের নানান উপকূলে আছে তাঁর শাখাপ্রশাখা। খোঁজখবর নেয় তারা পালা করে। ওদের ছবিও মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে মুঠোফোনের ছোট্ট পর্দায়।

এমনি করে দিন কেটে যায় আম্মার। তেষট্টিতে পা দিয়েও গৃহকর্ম সামাল দেন একা হাতে। কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই। নেই কোন অভিযোগ। যুগ যুগ ধরে একই দিনপঞ্জিপ্রার্থনা, ঘরকন্না আর স্নানাহার শেষে ভাতঘুমের পালা এলে বালিশের পাশে রাখা নজরুল, রবীন্দ্র, শরৎ, মানিক, রোকেয়া, হুমায়ুনরা সঙ্গ দেন আমার মা’কে

পুনশ্চঃ নানান দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করছে একে একে। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে যার কর্মক্ষেত্রে। ফেরেনি কেবল একজন, তবে সেই যেন থাকে বেশী কাছে। বছর খানেক হয় ছোট পুত্রের জন্য বউ এনেছেন। ঘরোয়াভাবে সংসারের সুবর্ণ জয়ন্তীও পালন করে ছেলেমেয়েরা। বাড়িতে আসছে নতুন শিশু। আবার জমবে মেলাপ্রতীক্ষায় তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী নেতৃত্বের অভিনব অধ্যায়
পরবর্তী নিবন্ধবাড়ন্ত তাপমাত্রা এবং হিট অফিসার