বাংলার খোকা

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ১৬ মার্চ, ২০২২ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

মধুমতির কোলঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ছোট্ট একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের এই টুঙ্গিপাড়াতেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় শেখ পরিবারে লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের ঘর আলো করে জন্ম নেন এক পুত্রশিশু। আদর করে বাবা নাম রাখলেন ‘খোকা’।
টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল পরিবেশে সবার আদরের খোকার জীবন কাটে দুরন্তপনায়। মধুমতির ঘোলাজলে গ্রামের ছেলেদের সাথে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় খোকা ছিলেন দস্যি বালকদের নেতা। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর এসব তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত।
ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন খোকা। পুষতেন বানর ও কুকুর। তারা খোকা যা বলতেন তাই করত। এসব পোষা পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি অপরিসীম মমতা ছিল তাঁর।
ছোট থেকেই তিনি ভারি দয়ালু ছিলেন। কোনদিন দেখলেন, কোনো ছেলে ভীষণ গরিব, টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে ভারি কষ্ট পায়, অমনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনও ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন তাঁর নিজের বইপত্র। এমনকি একদিন খালি গায়ে স্কুল থেকে খোকা বাড়ি ফিরে আসেন। মা জামাকাপড় কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘সহপাঠী একজনের গায়ে কিছু নেই তাই তাকে দিয়ে দিয়েছি।’
এতক্ষণ যে দুরন্ত, দয়ালু খোকার কথা বলছি, তিনি আর কেউ নন, বাঙালির মুক্তির দূত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
গ্রামবাংলার একটা কথা আছে, সকালের সূর্য বলে দেয় সারা দিন কেমন যাবে। বঙ্গবন্ধুর ছোটকাল থেকে তার চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় তা হলো- মানবদরদী, বন্ধুপ্রীতি, ধর্মপ্রীতি, পিতামাতার বাধ্য সন্তান, উদ্ভাবনী, কর্মচঞ্চল, উদার মানসিকতা, তেজি, নেতৃত্বের যোগ্যতা, সাহসী, সত্যবাদী, যেকোনো স্থানে কথা বলা, বক্তৃতা দেয়ার সম্মোহনী শক্তি, বড়দের প্রতি সম্মানবোধ ইত্যাদি গুণ তাঁকে সকালের আলোকোজ্জ্বল সূর্যের মতো করে তুলেছে। তাঁর হাত ধরে হাজার বছরের গ্লানি মুছে যাবে, মানুষ পাবে স্বাধীনতার আনন্দ তা ছোটকালেই প্রকাশ পেয়েছিল।
সত্যি তাই, টুঙ্গিপাড়ার সবার সেই আদরের খোকা জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন বাঙালি জাতিকে। তাঁর দুরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি উপহার পেয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, একটি পতাকা। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে ১৮ বার জেলে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ তিনি মোট সাড়ে ১১ বছর কারাবন্দি ছিলেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার।
বাঙালির অধিকার আদায়ে আপসহীন নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুদের প্রিয় বন্ধু। তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর দুয়ার ছিল খোলা। তাই বড়োদের মতো শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’।
১৯৬৩ সালের ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত শিশুমেলায় বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’
শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তারা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। এই স্বপ্ন আমাদের চেতনায় জাগিয়ে দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর শিশুপুত্র রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুদের প্রতীক। তিনি অনুধাবন করেছেন শিশুর কাছে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। ওদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। এ লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। এদিন শিশুরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিজেদের জীবনকে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করে।
শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে ১৯৭২ সালের একটি ঘটনা। এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বের হন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি হঠাৎ দেখলেন একটি ছোট ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাছে ডাকার পর ছেলেটি জানায়, তার পা ব্যথা করছে বলে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখেন যে, জুতার মধ্যে একটি পেরেকের সুঁচালো মাথা বেরিয়ে আছে, যার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই শিশুটিকে চিকিৎসা করানোর জন্য তাঁর দেহরক্ষীকে নির্দেশ দিলেন। আর পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। তার হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দিলেন।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সমাজ, মানুষ এবং রাজনীতির মধ্যে যত বিভেদই তৈরি হোক না কেন, প্রতিটি শিশুকে সাম্য ও সমতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। শিশুদের প্রাণে জাগাতে হবে অসামপ্রদায়িক চেতনা। সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে নতুন থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে চলার যে শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক, সেই শিক্ষাই ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন শিশুর অন্তরে। আজকের শিশুরা একদিন সাম্য ও সমতার বিশ্ব নির্মাণে হয়ে উঠবে আগামী দিনের নেতৃত্বদানকারী।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা আজকের শিশু-কিশোর। দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কিত পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে আজকের শিশু-কিশোরদের চিনতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে চেনা মানেই বাংলাদেশকে চেনা। শিশুদের সত্যকে জানতে হবে। মানবিক হতে হবে। উদার হতে হবে। এসব গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশকে ভালোবাসতে হবে। বড়োদের কাছ থেকেই শিশুরা নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’
এমন উপলব্ধি তিনিই করতে পারেন, যিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা বাঙালি জাতির মুক্তির দূত হয়ে। হে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তোমার জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা, সালাম আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবুকের ভেতরে মুজিবুর নাম
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা