বাঁশখালী গার্লস ক্রিকেট ক্লাব

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

বাঁশখালী একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। উপজেলাটি সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রপথে বিভিন্ন জায়গার লোক জীবিকার তাগিদে, ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারের জন্য, ধর্ম প্রচারের জন্যে ও বিভিন্ন কারণে এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।

বাঁশখালী উপজেলার একটি গ্রাম বাণীগ্রাম। এই বাণীগ্রামের নয়নাভিরাম ছোট্ট টিলার উপর ছয় একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠ বহু শিক্ষাব্রতী মানুষের প্রচেষ্টার ফসল।

এই গ্রামেই একটা সংগঠনের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুল দেখবার আমন্ত্রণ পেয়ে দুপুরে গিয়েছিলাম সেই স্কুলে। চমৎকার, ছিমছাম, পাহাড়ের উঁচুনিচু টিলার মাঝে মাঝে অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট। বিশাল জায়গাজুড়ে স্কুল ও খেলার মাঠ। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে উপরে সিঁড়ি ভেঙে যেতে যেতে মেয়েদের হট্টগোল শুনতে পেলাম। বন্ধের দিনে এতো হৈচৈ? জানলাম মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে। আগ্রহ বাড়লো দেখার। সত্যি অবাক করার মতো। একটা ব্যানারে লেখা বাঁশখালী গার্লস ক্রিকেট ক্লাব।

তিনজন প্রশিক্ষক আর অনেকগুলো কিশোরী মেয়ে। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে আমার বড্ড আনন্দ হচ্ছিল। যে মেয়েগুলো ক্রিকেট খেলছে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আমরা যারা গিয়েছিলাম ওখানে।

আমাকে একজন বললেন, আপনি কথা বলতে চান মেয়েদের সাথে? কেউ একজন প্রশিক্ষককে জানালেন। বল শেষ হবার পর মেয়েরা এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলো। আমাদের পরিচয় জানার পর তাদের উচ্ছ্বাস বেড়ে গেলো কথা বলার জন্য। আমরা সকলেই তাদের সাথে কথা বললাম। তাদের খেলাধুলা নিয়ে, বাল্যবিবাহ নিয়ে, লেখাপড়া নিয়ে। প্রতিটা মেয়েরই ইচ্ছে ক্রিকেট খেলে নিজের ভিত মজবুত করবার। তারা জানালো নিজেদের যোগ্য করে তোলার পরেই বিয়ে। এই ভর দুপুরে, আর প্রচণ্ড শীতেও সকলেই মাঠে চলে আসে অনুশীলনের জন্য। তাদের অদম্য ইচ্ছে এই ক্রিকেট খেলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। তাদের যে স্বপ্ন, সেভাবেই তারা গড়ে তুলছে নিজেদের। তারা স্বপ্ন দেখে ক্রিকেটই একদিন তাদের পরিবারের স্বচ্ছলতা বয়ে আনবে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে নারীদের পথচলা খুব বেশিদিনের নয়। ১৯৮২ সালে একদল উৎসাহী মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের পথচলা। তবে ক্রিকেটে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নড়েচড়ে বসে ২০০৬ সালে। সে বছরের এপ্রিল মাসে উইম্যান্স উইং গঠন করে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করে বিসিবি। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে সরাসরি ওপেন টুর্নামেন্টে। আর তখনই স্বপ্ন দেখা শুরু।

হাঁটিহাঁটি, পাপা করে শুরু করা নারী ক্রিকেটে গতি আরও বাড়লো। ২০১১ সালে মিললো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মর্যাদা। এরপর ২০১২ সাল থেকে বিসিবি’র কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় আসে নারী ক্রিকেটাররা।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা আসে নারীদের হাত ধরেই। ২০১৮ সালে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা জয় করেন। এরপর নারী ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন বুননের মাত্রা যোগ হলো।

খেলাধুলায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮৩ শতাংশই আসেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। যেখানে নারীদের খেলাধুলায় আসাটা ভালো চোখে দেখা হয় না।

এই নারী ক্রিকেটারদের আরও ভালো করার তাগিদ দিতে হবে পরিবার ও এলাকাবাসীকে। এতে অনেক পরিবার উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীদের সেই অধিকার দেবে বলে মনে করি। সীমাবদ্ধতা তো অবশ্যই কিছু আছে।

বলছিলাম বাঁশখালীর সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এনজিও সমন্বয়কারী ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি নজরুল ইসলাম তেমনিভাবেই খুঁজে খুঁজে, পরিবারকে বুঝিয়ে এই মেয়েদের সংগঠিত করেছেন। নজরুল ইসলামের অক্লান্ত পরিশ্রম আর বাঁশখালিবাসীর মিলিত উদ্যোগে ২০২৩ সালে ৪৫ জনের দল নিয়ে ‘গার্লস ক্রিকেট ক্লাব’ গঠন করেন এবং একই বৎসরের ২৪ আগস্ট তারা মাঠে নামেন খেলতে।

উনি জানালেন, আমরা অবশ্য যতটুকু পারি, চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু হ্যাঁ, অন্যান্য দেশের নারীরা যেভাবে এগিয়ে আসে, তাদের পরিবার যেভাবে এগিয়ে আসে, সেভাবে তুলনা করলে এখানো আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু আমরাও আস্তে আস্তে সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছি। এ থেকে বের হতে হবে আমাদের। এই কিশোরী মেয়েরা আর্থিকভাবে খুবই দুর্বল। এদের পরিবার চায় কাজ করে উপার্জন করুক। সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসুক।

এই মেয়ে ক্রিকেটাররা যখন ভালো করবে, তখন অনেকেই এগিয়ে আসবে। আর্থিকভাবে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

বাঁশখালী ‘গার্লস ক্রিকেট ক্লাব’ নারী ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স ভালো। সম্ভাবনাও বেশ আছে জাতীয় পর্যায়ে খেলবার ।

সকলের সহযোগিতায় এই মেয়েরা একদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় পারফরম্যান্স করতে পারবে। দেশ ও জাতির মান রাখতে পারবে তাদের অদম্য ইচ্ছায়। আমরা যতো বেশি ওদের সুযোগ দিতে পারবো, ততোই ওরা এগিয়ে যাবে।

আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে নারী ক্রিকেট নিয়ে আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। আমাদের কিন্তু জাতীয় দলের পাশাপাশি পাইপলাইনটাও বেশ শক্ত। নারীরা ক্রিকেটে এগিয়ে আসছে এটা অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্ধেক ঔষধ
পরবর্তী নিবন্ধবানীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক সম্মাননা