অর্ধেক ঔষধ

জেসমিন ইসলাম | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

দুই হাজার ঊনিশ সালে আমার ক্রমাগত শারীরিক অবস্থা বিপন্ন হলে পার্শ্ববর্তী দেশ দিল্লি শহরের একটি হসপিটালের চিকিৎসকের বিবেচনায় অপারেশনের বাধ্যবাধকতা দেখা দেয়। অপারেশনের জন্য আমার শারীরিক সক্ষমতার পরিমাপের প্রেক্ষাপটে সম্পৃক্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়েছে প্রায় এক মাসের মত। হার্টের সক্ষমতার পরীক্ষায় আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম বেশি। কষ্টসাধ্য এবং ভীতিকর পরীক্ষানীরিক্ষার শেষে আমি, আমার ছোট ভাই এবং আমাদের মেডিকেল এজেন্ট রিপোর্ট নিয়ে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে দেখা করলাম। চিকিৎসক কিছুটা অসন্তোষজনক ভঙ্গি করে শুদ্ধ বাংলায় রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, অল্পের জন্য রক্ষা হলো। অপারেশনের পরে হৃদযন্ত্রের প্রতি যত্নবান হতে হবে। আমার বাঙালি মেডিকেল এজেন্ট তখন ডাক্তারকে জানালেন, আমার দুইটি মেয়ে চিকিৎসক। তৎক্ষণাৎ তিনি আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে সৌজন্যতা প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে আমাকে বাংলায় বললেন, আপনাকে অনেক বিষণ্ন দেখাচ্ছে, সাহস রাখবেন, আপনার অপারেশনের সার্জেন্ট অনেক অভিজ্ঞ এবং সাকসেসফুল। ঈশ্বর সহায় হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য চিকিৎসকের কাছ থেকে শারীরিক সক্ষমতার ছাড়পত্র পাওয়ার পর অপারেশনের দিন ধার্য করা হলো। অপারেশনের এক সপ্তাহ আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ একটি কাউন্সিলিং সভা করলো। সেখানে বোধগম্য প্রয়োজনীয় কথাটি ছিলো, রোগীর মনে একটি কথা আসা স্বাভাবিক ‘আমিই কেনো আক্রান্ত হলাম’, ‘আমিই কেনো ভুক্তভোগী’। এই জাতীয় চিন্তা অসুস্থতা থেকে উত্তরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই চিন্তা করা যাবে না। অপারেশনের দিন যতই কাছে আসছিলো, নিজেকে সংহত রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। আমার কিশোর ছেলেটির জন্য বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম।

আমার অপারেশন হলো নির্ধারিত দিনে। দুইদিন আগেই হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিলো। হসপিটালের অফিশিয়াল ম্যানেজমেন্টের কাগজপত্রের কাজগুলি আমি এবং আমার ছোট ভাই সম্পাদন করলাম। আমার স্বামী অপারেশনের দিন দেশ থেকে গিয়ে পৌঁছলেন। প্রথম বারের মতো অপারেশন থিয়েটার দেখলাম। মাতৃসম অবয়বের নারী এনেস্থিশিয়ার চিকিৎসক আমার মাথায় হাত রাখলেন, তরুণ ডাক্তার ইঞ্জেকশন পুশ করছে হাতে। চার ঘণ্টা পর আইসিইউতে আমার নামের ডাক শুনে চোখ মেলে বললাম, পানি পানি। এনেস্থিশিয়ার চিকিৎসক আমাকে বললো দেখো তোমার স্বামী এবং ভাই তোমাকে ডাকছে। স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ওপারে তাদের দুজনকে দেখে চোখের পানিতে ভেসে গেলাম।

সেই থেকে ঔষধ সেবন গভীর নিয়তি হয়ে গেলো। কিছু ঔষধ আমৃত্যু সেবন করতে হবে, এর অন্যথা হবে না। যোগ্য লোকেরা আজীবন সম্মাননা পেয়ে থাকে, আমি অর্জন করলাম আজীবন ঔষধ খাওয়ার দুর্ভাবনা। স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ যাপিত জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধের শিথিলতা সেই প্রায়শ্চিত্তই করছি বৈকি। ‘আইসিইউ’ তে এক সপ্তাহ এবং কেবিনে আটদিন মোট পনের দিন হসপিটালে এবং আরো একমাস হসপিটাল সংলগ্ন বাসায় অবস্থানের পর দেশে ফিরে আসলাম সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে। দুই মাসের সমপরিমাণ ঔষধ সাথে আনলাম। পরে একজন আমাদের সুহৃদ কলকাতা বাংলাদেশ পেশাগত কাজে আসা যাওয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ঔষধ আনাতাম। কোভিডকালীন সেই ব্যবস্থাপনা বন্ধ হয়ে গেলো। দুশ্চিন্তা হতেই জানতে পারলাম, চট্টগ্রামে একটি ঔষধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আমার প্রয়োজনীয় ঔষধগুলি বিপণন করছে। ঔষধগুলি নিশ্চয়তার জন্য বাসায় আগাম সংরক্ষণ করে থাকি। দেশে আসার পর ঢাকায় অবস্থানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আছি। প্রতিবার আশা করি ঔষধের পরিমাণ সংখ্যা কমাতে পারে। প্রাসঙ্গিক পরীক্ষা নীরিক্ষার রিপোর্ট দেখে ঔষধ কমাবার সুযোগ হয়ত চিকিৎসকের থাকে না। এইবার বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে আমার সংশ্লিষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে আজীবন সেবনকারী বাধ্যতামূলক ঔষধগুলির মধ্যে একটির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে আরেকটির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কমিয়ে দেয়া ঔষধটি এককভাবে সাধারণত পাওয়া যায় না, তাই আমাকে সম্পূর্ণ একটি ঔষধকে ভেঙ্গে দুইভাগ করে অর্ধেক খেতে নির্দেশ দিয়েছে।

সেই অনুযায়ী সম্পূর্ণ ঔষধটিকে অর্ধেক করতে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু ভেঙ্গে অর্ধেক করার পর অর্ধেক ঔষধটির হাহাকার আমি শুনতে পাই। ঔষধ একটি জড় পদার্থ, কিন্তু আমার চেতনায় অর্ধেক ঔষধটির সম্পূর্ণ ঔষধটির সাথে বিচ্ছেদের অসহায়ত্বের দৃশ্যমানতার অনুরণন হয়। কবি জানিয়েছেন ‘যতদিন যবে না হবে না হবে তোমার অবস্থা আমার সম, ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে, বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।

দুই হাজার একুশ সালের জুলাই মাস। অসুস্থ আমি চট্টগ্রামের ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের দোতালার কেবিন থেকে জানালা দিয়ে বিকেল বেলায় উঁচু পাহাড়ের নারিকেল গাছের পাতার আড়ালে বিদায়ের বিষণ্নতায় ভারাক্রান্ত অর্ধেক ডুবন্ত সূর্যকে দেখতাম। নিচের তলায় আমার স্বামী মার্চেণ্ট মেরিনার ক্যাপ্টেন মতিউল ইসলাম আশঙ্কাজনকভাবে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসারত ছিলেন। দু’জন একসাথেই আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন।

সৃষ্টিকর্তা একক সত্তা, অংশীদারহীন। অথচ তাঁর বিশ্বপ্রকৃতি, সৃষ্টি পরস্পর অংশীদারিত্বের বুননে গাঁথা। অংশীদারিত্বের ছিন্নতার বেদনার ভার সৃষ্টিই বহন করে। সবরকম বহন ভার আমাকে দিয়ে আমার অংশীদার জুলাই সাতাইশ তারিখ চলে গেলেন

পূর্ববর্তী নিবন্ধউন্নয়নের আওতায় আসবে পটিয়া পৌরসভার প্রতিটি সড়ক
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালী গার্লস ক্রিকেট ক্লাব