বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা

পিংকু দাশ | বৃহস্পতিবার , ১৭ মার্চ, ২০২২ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি ও কৃষকের সামগ্রিক উন্নতির দিকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন এদেশের শতকরা আশি ভাগ লোক গ্রামে বাস করেন। তাই তিনি গ্রামকে সার্বিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, নৌকায় ঘুরেছি, সাইকেলে ঘুরেছি, পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি। আমি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সমস্যার সঙ্গে জড়িত আছি, আমি সব খবর রাখি’। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে গ্রামোন্নয়ন করতে হলে কৃষি খাতের উন্নয়নের বিকল্প নেই।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। এজন্য ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে অন্যতম দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন ভালো বীজ, সার ও সেচের। এ উপলব্ধি থেকেই কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না, দেশের কোনো জমি পড়ে থাকবে না এবং জমির ফলন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্য কৃষক সমাজকেই সচেষ্ট হতে হবে’। তিনি গরীব কৃষকের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ করেন। পাকিস্তানি শাসনামলে কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেয়া হয়। ৩৫ শতাংশ ভূমিহীন কৃষকদের জন্য জমির ব্যবস্থা করতে বঙ্গবন্ধু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জমির মালিকানা কমিয়ে এনে ১০০ বিঘা করেন। মহাজন ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ এর মাধ্যমে নদী ও সাগরগর্বে জেগে ওঠা চর জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। গরীব ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। পুনর্বাসনের আওতায় বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কৃষকদের বীজ, সার ও কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ বিতরণ করেন।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে ও স্বল্পমেয়াদে উন্নত চাষাবাদের জন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেন। সেই সাথে কৃষি ঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন।
বঙ্গবন্ধু মনে করেন কৃষি উন্নয়ন ছাড়া গ্রামোন্নয়ন অসম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি বেশ কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। দেশে প্রথম কৃষি ঋণ ব্যবস্থা চালু করেন। উচ্চ সুদে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এবং কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গ্রামবাংলার কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, চা গবেষণা ইনষ্টিটিউটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর এসব সচেতন কৃষিদরদী নীতির ফলে দেশের কৃষি স্বল্পতম সময়ে একটি শক্ত ভিত্তির মধ্যে দাঁড়াতে পেরেছিল।
কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর মুক্তির পথ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায় কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। গুরুত্বের বিবেচনায় মালিকানাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা ক্রম হিসেবে নিরুপণ করেন। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রস্তাব করেছিলেন, গ্রামের প্রত্যেকটি কর্মঠ মানুষ এই বহুমুখী সমবায়ের সদস্য হবেন। যার যার জমি সেই চাষ করবে, কিন্তু ফসল ভাগ হবে তিনভাগে। কৃষক, সমবায় ও সরকার। তিনি বলেন সমবায়ের মাধ্যমে গরীব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের সুষম বণ্টনব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে আর জোতদার ধনী চাষীর শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করবে। ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে ভূমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। নির্ধারিত সীমার বাইরে জমি ও সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থা করেন।
স্বাধীনতা উত্তরকালে কৃষি সেক্টরে একটি উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল নামক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির জন্য যান্ত্রিক প্রযুক্তি ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণার উপর গুরুত্ব দেন। ধান ব্যতীরেকে বহুমুখী ফসল গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয় এই ইনস্টিটিউটে। কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি গুরুত্ব দেন কৃষি গবেষণার ও কৃষি শিক্ষার। কৃষি শিক্ষায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রয়ারি চাকরি ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন।
দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুভব করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং তখন থেকেই ধানের উপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবিত হয় এবং ধান ব্যবস্থা শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এসব কার্যক্রমের ফলে সেসময় ধানের আমদানি অর্ধেকে নেমে আসে। সোনালী আঁশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে ১৯৭৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।
কৃষি উন্নয়ন বলতে বঙ্গবন্ধু শস্য, মৎস্য, পশুপাখি ও বনজসম্পদ অর্থাৎ সার্বিক কৃষি খাতের উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুধু চাল আটা নয়, মাছ-মাংস, ডিম, দু্‌ধ, তরিতরকারিও আছে। সামগ্রীক কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে শস্য, বীজ, তৈল, পশু সম্পদ, পোল্ট্রি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অপরিহার্য বনজসম্পদ, নদী, জলাশয় ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
গ্রামীণ নির্মল পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু এ দেশের কৃষক-শ্রমিকদের খুব ভালোবাসতেন। এ কথার প্রমাণ মেলে সে সময় জাতিসংঘে দেয়া তাঁর এক ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘করাপশান আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশান আমার বাংলার মজুররা করে না। করাপশান করি আমরা শিক্ষিত সমাজ’। দেশ স্বাধীনের পর ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছিলেন কৃষকদরদী বঙ্গবন্ধু। কৃষকদের তিনি সোনার বাংলা গড়ার মূল কারিগরের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের দীর্ঘ ২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষিখাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনি কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। মাঝখানে কিছু সময় আবার কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন থমকে গিয়েছিল। ২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবার ক্ষমতায় আসার পর কৃষি উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাঁর গতিশীল নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় দেশ আজ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষির নানা ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলা করেও কৃষিতে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বে বিরল নজির স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে সহায়ক হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলা করেও কৃষিতে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বে বিরল নজির স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে সহায়ক হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘ওই মহামানব একবার এসো ফিরে’
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : বিশ্ব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়