প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩১ আগস্ট, ২০২২ at ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

হজ্ব ও হাজীর অনুভূতি

গত ৮ জুলাই আরাফাতে অবস্থানের মাধ্যমে ৬ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। হজ্বের ৩ ফরজ। এহরাম বাঁধা, ৯ যিলহজ্ব আরাফাতে অবস্থান, অতঃপর পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করা। মৌলিকভাবে হজ্বের ৩ ফরজ হলেও ৯ যিলহজ্ব আরাফাতে অবস্থানই হজ্বের প্রধান দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। সৌদি আরবের কঠোর দিক নিদের্শনায় এই বছর ১০ লাখ নর-নারী হজ্ব করেন। যাদের বয়স ৬৫ বছরের নিচেও করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ থাকতে হবে।
করোনা মহামারীর কারণে গত বছর ২০২১ সালে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে ৬০ হাজার নর-নারী হজ্ব করতে চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে হজ্ব করেন ৫৮ হাজার ৫ শত ১৮ জন। তার আগের বছর ২০২০ সালে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে মাত্র ১০ হাজার নর-নারী তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ পান। চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত হন ১ হাজার জন। বাস্তবে হজ্ব করেন ৯৩৭ জন।
সৌদি সরকার হজ্বের ক্ষেত্রে অনেকটা ২০১০ সাল থেকে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করে তালিকাভুক্ত হয়ে হজ্ব করার নিয়ম-নীতি চালু করে। ফলে ৩৫-৪০ লাখ নর-নারী হজ্ব করার স্থলে প্রায় ২৬ লাখে নেমে আসে। অর্থাৎ অনেকটা ২০১০ সাল বা তারও আগে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে যে কেউ হজ্ব করতে পারত। ফলে মহানগর জেদ্দাসহ সারা সৌদি আরব থেকে লাখ লাখ নর-নারী হজ্ব করতে চলে আসতেন। এতে হজ্ব পালনে শৃংখলা রক্ষা করা সম্ভব হত না।
কিন্তু করোনা মহামারীর আগে প্রায় ২৬ লাখ নর-নারী হজ্ব করে আসছিল। তাতেও সৌদি সরকারের পক্ষে যথাযথ নিয়ম শৃংখলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ত।
সৌদি সরকার, সরকারের পক্ষে প্রশাসন, এমনকি সৌদি নাগরিকসহ সবক্ষেত্রে তারা শৃংখলার পক্ষপাতি। যা ৬ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে সৌদি সরকারের বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা হয়ত অনেকটা কার্যকর নয়।
জানি না করোনা মহামারীর অজুহাতে সৌদি সরকার ৬ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে নিয়ম শৃংখলা ধরে রাখতে ১০ লাখে সীমিত করল কিনা। তবে তা আগামী হজ্বে বুঝা যাবে। যেহেতু ওমরাহর ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের উর্ধ্বেরও অনুমতি ছিল এবং সংখ্যার দিক দিয়েও কোন বিধি নিষেধ ছিল না। ফলে গত রমজানে দুই পবিত্র হারমে লাখ লাখ নর-নারীর সমাবেশ ঘটে। পবিত্র মক্কায় ২৫/৩০ লাখ বা আরও বেশি নর-নারীর সমাবেশ ঘটেছিল।
অর্থাৎ সৌদি সরকার ওমরাহর ক্ষেত্রে এক নীতি হজ্বের ক্ষেত্রে আরেক নীতি মনে হচ্ছে। হজ্বের ক্ষেত্রে এই নীতির মূল কারণ মনে হয় ৬ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমকে নিয়ম শৃংখলার মধ্যে রাখা। করোনা মহামারী না থাকলে বা এইভাবে কম থাকলে আগামী হজ্বে বোঝা যাবে হজ্বযাত্রী নিয়ে সৌদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি।
এই বছর বাংলাদেশে প্রায় ৬০ হাজার ভাগ্যবান নর-নারী হজ্ব করে দেশে ফিরে এসেছেন। তেমনিভাবে কাফেলা এজেন্সী প্রধান ও তাদের প্রতিনিধিরা দেশে ফিরে এসে অনেকটা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। ২০০০ সাল থেকে সৌদি সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এজেন্সী প্রথা চালু করতে নির্দেশনা প্রদান করতে থাকে। ২০০৪/৫ সাল থেকে সৌদি সরকার অনেকটা কঠোর অবস্থানে যায়। ফলে কাফেলা এজেন্সীর মাধ্যম ছাড়া আগের মত স্বতন্ত্র হজ্ব করা সহজতর রইল না। বাংলাদেশে প্রায় ১৬ শত মত সরকারী অনুমোদিত হজ্ব এজেন্সী রয়েছে। তৎমধ্যে কয়েক শ’ এজেন্সীর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। সরকারী অনুমোদিত এজেন্সী বাদেও দেশে শত শত কাফেলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এসব এজেন্সী কাফেলা হজ্ব ও ওমরাহ কারীর সেবার পাশাপাশি ব্যবসা করছে। ব্যবসা নয় এমন কাফেলা এজেন্সী শতে হয়ত ২/১ টি থাকবে।
হজ্ব ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। পবিত্র সফর, ধর্মীয় সফর, এবাদতের সফর। কিন্তু হজ্ব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে লাভবান হতে হজ্বযাত্রীর সাথে কৌশল অবলম্বন না করা চাই। যাতে হজ্ব ও ওমরাহকারীরা কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে ব্যথিত না হয়। হজ্বের পর দেশে এসে হাজীরা কাফেলা এজেন্সীর প্রতি চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায়। অপরদিকে হজ্ব এজেন্সী ও কাফেলার সাথে হাজার হাজার আলেম বিভিন্নভাবে জড়িত। এতে হাজীগণের অসন্তুষ্টি, ক্ষোভে ধর্মীয় ব্যক্তিগণের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
হজ্ব পালনের ক্ষেত্রে আগে ভাগে টাকার অংক বলা কঠিন। অতএব কাফেলা এজেন্সীর পক্ষে পরিষ্কার দিক নির্দেশনা দেয়া থাকা চাই। যাতে হজ্বযাত্রীর সাথে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। কিন্তু দেশে হাজারের অধিক এজেন্সী ও হাজার হাজার হজ্ব কাফেলার মধ্যে শতকরা কয়জন পরিষ্কার দিক নিদের্শনা দিয়ে হাজী নিচ্ছেন!
গত ২ বছর করোনা মহামারীর পর এ বছর অনেকটা হজ্বের নিকটতম সময়ে এসে সৌদি সরকার ১০ লাখ নর-নারীকে হজ্ব করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে। বাকী ৮ লাখ ৫০ হাজার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। তৎমধ্যে বাংলাদেশের কোটা পড়ে ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন। ২ বছরের ব্যবধানে ট্রান্সপোর্ট ও মিনা, আরাফাতে ভাল ব্যবস্থাপনার জন্য সৌদি সরকার টাকার অংক বাড়িয়ে দেয়। যার প্রভাব এসে পড়ে সরাসরি হজ্বযাত্রীগণের উপর। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা ৩ লাখ বা তার কম বেশি দিয়ে হজ্ব করতেন। সেখানে কাফেলা এজেন্সীরা ৫ লাখ ৫০ হাজার বা তার কম বেশি নিলেন। এ ক্যাটাগরি ৬ লাখ টাকার উপরে। ফলে হজ্বযাত্রীগণের হা-হুতাশ শুরু হয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে কাফেলা এজেন্সীর প্রতি অসহায়ত্বের মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ পেতে থাকে। অপরদিকে ৬৫ বছরের নিচে বয়স নির্ধারিত থাকায় হাজার হাজার মানুষ তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও হজ্বে যেতে পারেনি। এখানে হাজার হাজার হজ্বযাত্রী রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে। অর্থাৎ যারা যেতে পারছে না তারাও যেতে পারছে।
হজ্ব করে হাজীরা দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু হজ্বযাত্রীর মধ্যে কাফেলা এজেন্সীর প্রতি ক্ষোভ রয়ে গেছে। যা কোন মতেই বাঞ্চনীয় নয়। হজ্বযাত্রীগণকে বুঝতে হবে সৌদি সরকারের আইন কাফেলা এজেন্সীর মাধ্যমে হজ্ব করতে হবে। হজ্ব ব্যবস্থাপনা খুবই কষ্টসাধ্য। শত শত হজ্বযাত্রীগণকে ২ পবিত্র নগরীতে নিয়ে যাবতীয় আয়োজনের মাধ্যমে হজ্ব ও যেয়ারতের ব্যবস্থাপনা দিয়ে হাজীগণকে দেশে ফিরে আনা তত সহজ নয়। ইহা অত্যধিক কঠিন কার্যক্রম। অতএব এতে কম বেশি ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবে স্বাভাবিক। হাজীগণের উচিত হবে উদারতায় সবর শুকরে থাকা।
চট্টগ্রাম ও ঢাকার একাধিক হজ্ব এজেন্সী প্রধানের সাথে মোবাইলে আলাপ করি। করোনা মহামারীর পর ২ বছরের ব্যবধানে হজ্বের খরচ প্রায় ২ লাখ টাকা মত বেড়ে যায়। এতে হজ্বযাত্রীদের মধ্যে হজ্ব করে এসে অসহায়ত্ব ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। হজ্ব এজেন্সী প্রধানগণ উত্তরে বলেন মিনা আরাফাতে হজ্ব ব্যবস্থাপনা সৌদি হজ্ব কর্তৃপক্ষ আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়েছে। সাথে সাথে ২ বছরের ব্যবধানে আনুষঙ্গিক অন্যান্য হজ্বের খরচে বড় ধরনের তারতম্য এসে গেছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ আরও বেড়েছে ও সামনে বাড়বে।
কাফেলা এজেন্সীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন ধর্মীয় বিজ্ঞজনের সাথে আলাপ করি এই বছর হজ্বযাত্রীর হা-হুতাশ কোন পর্যায়ে পড়ে। আপনারা কাফেলা এজেন্সীরাও নিজেকে নিজে ঠিক মনে না করে প্রচেষ্টা, বিশ্লেষণ, পদক্ষেপ দরকার আছে। হজ্বযাত্রীগণের হ-হুতাশে কাফেলা এজেন্সীর ধর্মীয় দিক থেকে করণীয় আছে কিনা তা এজেন্সী/কাফেলার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন বিজ্ঞ আলেমের মতামত নেয়া আবশ্যক মনে করি। হজ্ব এজেন্সীর ও কাফেলার প্রতি আবেদন থাকবে তাদের এভাবে অর্থ নেয়া যাতে ধর্মীয় অনুশাসন বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য পদক্ষেপ নেয়া।
হজ্ব এজেন্সী হজ্বযাত্রীগণের জন্য নেয়ামত। শুধু টাকা, আইডি কার্ডের ফটোকপি, পাসপোর্ট দিলেই হবে। যাবতীয় আয়োজন এজেন্সীরাই করছে। এই নিয়ামতকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে কাফেলা এজেন্সীর প্রতি আবেদন থাকবে হজ্বযাত্রীর সাথে আলাপে স্পষ্টতা থাকা চাই। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধস্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত রাউজানে যুবককে একমাসের কারাদণ্ড