পুষ্পকথা

কুমুদিনী কলি | রবিবার , ২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

নামহীন, গোত্রহীন ফুলেরও কী অদ্ভুত মাদকতা! কী অদ্ভুত সৌন্দর্য! হয়তো বিজ্ঞানের ভাষায় তাহার অন্য নাম রহিয়াছে, কিন্তু এত বছরেও আমি তাহার অন্য কোনও প্রচলিত নামও খুঁজিয়া পেলুম না। হায় বিধাতা! তুমি কৃপাময়! তোমার অকৃত্রিম কৃপায় বিশ্বচরাচর নানান বিস্ময়ে পরিপূর্ণ।

পুবপাড়ের নানান ঝোপঝাড়ের মধ্য হইতে মাথা উঁচু করিয়া তাহার যেনো আকাশ ছুঁইবার ইচ্ছা। কিছুকাল অতিবাহিত হইতেই দেখতে পেলুম নববসন্তের আগমনে তাহার অতিশয় নিরীহ ডালপালাসমূহ আবার সতেজ, সজীব হইয়া উঠিল। ক্রমশ ধীরে ধীরে নবযৌবনপ্রাপ্ত হইয়া উঠিল সেই নাম না জানা তরুলতা। শাখায় শাখায় তাহার নব পত্রপল্লব। বসন্তের ঝিরিঝিরি পবনসমেত হেলিয়া দুলিয়া কাহার দৃষ্টি কাড়িতে চাহিত! এ যেনো ষোড়শীর হৃদয়ের চঞ্চলতা! অতঃপর দেখিলাম তাহাতে মুকুল আসিয়াছে। পুষ্পরেণু তাহার পাপড়িদল বিকশিত করিবার প্রস্তুতি লইয়াছে বোধকরি।

কিন্তু অত উঁচু শাখা অবধি আমার ক্ষীণ দৃষ্টি পৌঁছাতে পারিত না। আমি চাতকের মতোন তৃষ্ণায় মরিতে লাগিলাম। সে পুষ্পরেণু আমায় যেনো চুম্বকের মতোন টানিতে লাগিল। আমার সমস্ত দিবস শুধু তাহার চিন্তাতেই মগ্ন। কখন সে ফুল ফুটিবে, আমি দেখিয়া মরি।

উত্তরপুবের কোণে সেদিন ভীষণ ঘন কালো মেঘ জমিয়াছিলো। মেঘের ভারে সেদিন আকাশের যেনো টলমল অবস্থা। অবস্থাখানা এমনি যেনো অমনিই অবোধ বালিকার আঁখিযুগল হইতে টপটপ করিয়া অশ্রু বর্ষিত হইবে। এ অশ্রুজল রোধ করিতে পারে, এমন সাধ্যি কার! পেছনে ঘন কালো মেঘ, তাহার উপর ক্যানভাসে আঁকা চিত্রপটের মতোন সেই বৃক্ষকে আমি অবলোকন করিলাম। তাহার সমস্ত পত্রপল্লব জুড়িয়া কেবলি ফুল আর ফুল। ধবধবে সাদা বলা চলেনা, তবে সাদাটে এ ফুল যেনো কালো আকাশখানাকে উজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছে। আমি অভিভূতের ন্যায় দৃষ্টিপাত করিয়া রহিয়াছি। সমস্ত জগৎ সংসার যেনো মুহূর্তের জন্য ভুলিয়াছি। ঝমঝম করিয়া বর্ষণ শুরু হইল। বৃষ্টিস্নাত সেই ফুলের সৌন্দর্য আমি আজও ভুলিতে পারি নাই।

সেই ফুলের মিহি সৌরভ আজও আমায় মাতাল করিয়া রাখে, এমনি মাদকতা মেশানো সৌরভ আমি আজও কোত্থাও খুঁজিয়া পেলুম না। বহুকষ্টে অত উঁচু শাখা হইতে কিছু ফুল আমি তুলিতে পারলুম। কিছু কুড়াইয়া পেলুম। হাতে লইতেই মনে হইলো, এ যেনো শুধু আমারই। বালিকার প্রথম প্রেমের মতোন! সারাদিনমান কাটাইয়া সুঁই সুতায় তাহার মালা গাঁথিলাম। খোঁপায় জড়াইয়া, নীল শাড়িখানা পড়িয়া লইলাম। কাজলে চক্ষুজোড়া আঁকিয়া লইতেই মনে হইলো, একখানা নীল টিপ পেলুম না। যে পুষ্পের ইতিবৃত্ত কহিলাম, সে আমার বড় আপনার ছিলো। প্রতি বসন্তের শেষে সে আলো করিয়া আমার ছোট্ট জীবনখানা ভরিয়া তুলিত। কিন্তু হায়! সে আর নাই। আমার এ জীবনে তাহাকে আর খুঁজিয়া পেলুম না। আমার অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা লইয়া সে কোথায় পলাইয়া গেলো? আমি তাহাকে আর খুঁজিয়া পেলুম না!

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁচুন নিজের ইচ্ছে মতোন
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে