দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক অচল বাইক্কা কার্ড

আমাদের, মানে পিতাপুত্র দুজনের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন শেষে সপুত্রক আউটলেটির বসার জায়গায় এসে দ্রুত টেবিলগুলো জরীপ করে একটা যুতসই টেবিল নিয়ে বসলাম। নাহ যেমন টেবিল খুঁজছিলাম তেমন পাওয়া গেল না। ভেবেছিলাম অনেকটা কাচঘরের আদলে তৈরি এই আউটলেটে, নিশ্চয় এমন একটা টেবিল পাওয়া যাবে, যেখানে বসলে গোটা এলাকার একটা ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যাবে, যাতে মনে হবে মুতিয়ানুগ্রামের এই গাছপালা বেষ্টিত পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে খাচ্ছি পুরাই অপ্রাকৃতিক গরু মুর্গি আর বলরুটিতে তৈরি আম্রিকান বার্গার! তাতে তৈরি হবে যাকে বলে একদম দুই বিপরীতে সহাবস্থান! কিন্তু ঐ ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ না পেলেও যে টেবিলটা দখলে নিলাম সেটাও ভালই বলতে হয়। মোটামুটি বলা চলে ২৫০ /২৬০ ডিগ্রি ভিউ যাচ্ছে এতে। তাতেই চমৎকার লাগছে!

এদিকে আমরা ভিন্ন এক্ষণে এখানে আর অন্য কোনো ক্রেতা না থাকায় যে ক্রেতাশূন্যতার ঝিমুনিতে ভুগছিল এতক্ষণ এই আউটলেট, সদলবলে আমরা উপস্থিত হওয়ার পরও সেই ঝিমুনি ভাঙেনি। বড়ই গা ছাড়াভাবে যে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের আর রসুই ঘরের কর্মীরা, দেখতে পাচ্ছি তা টেবিলে বসেই। কিন্তু দীপ্র গেল কোথায়! ওকে তো কাউন্টারের সামনে গভীর মনোযোগে মেন্যু দেখতে দেখেছিলাম টয়লেটে যাবার আগে। এখন সে গেল কোথায়? টয়লেটে গিয়ে থাকলে তো আমাদের সাথে তার দেখা হবার কথা। তা তো হয়নি !

কী ব্যাপার তোমরা দু জন বসে আছো দীপ্র কোথায়’? নিজের মনেরই এই একই প্রশ্ন, এইমাত্র টয়লেট থেকে ফিরে আসা লাজুর মুখ থেকে তুমুল উদ্বেগের বেগে বেরিয়ে আসতেই সাথে সাথেই সেটির ব্রেকও কষে ওর জিজ্ঞাসা এলো

ও কি টয়লেটে গেছে’ ?

ও যে টয়লেটে যায়নি তা তো আমি নিশ্চিত। কিন্তু যদি তা বলি, তবে একটু আগে মায়ের মনের যে উদ্বেগটিকে লাজু নিজেই ব্রেক চেপে থামিয়েছিল সেটির আবার গতি বৃদ্ধি হয়ে যায়। তাই ঐ ব্রেক ধরা প্রশ্নটির উত্তরে ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’ ভাব ধরে উঠে দাঁড়ালাম ওকে খুঁজতে।

ঐ তো ভাইয়া’। অভ্রর এ কথার সাথে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমারও চোখ ৬০ /৭০ ডিগ্রি কোণে কাচের দেয়ালের ওপাশে যেতেই দেখা পেলাম ওকে। একটু দূরের কেন্টাকি চিকেন এর আউটলেট থেকে বেরিয়ে আসছে ও এদিকেই। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো শান্তি পেলাম তাতে।

ওকে ধরে আনো তো। এইভাবে একা একা বের হয়ে সে গেল কেন ওখানে?” পুত্রের প্রতি স্বাভাবিক উদ্বেগজনিত তার মায়ের এই উষ্মা প্রশমনের উপায় একটাই, তা হল চুপ থাকা। এছাড়া ও তো আসছে এদিকেই, অতএব ধরে আনার তো দরকার নেই। তাই তার বদলে অভ্রকে বললাম, চল বাবা আমরা অর্ডার দিয়ে আসি। আর দেরী করা ঠিক হবে না।

অর্ডার দিতে গিয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, দুই কিশোরের আড়ষ্ট দেহভাষা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে আমারও দেহভাষাই এখানে একমাত্র ভরসা। এই মতিয়ানু গ্রাম থেকে আসা এই কিশোর কিশোরীরা আমাদের মতো বাঙাল চেহারা সুরতের লোক সম্ভবত আজই প্রথম দেখেছে। যার ফলে ইয়েস নো ভেরি গুড মার্কা ইংরেজি যদি তারা কিছু জানেও, তাও ইতিমধ্যে তারা গুলিয়ে ফেলেছে।

অতএব কাউন্টারের উপরে পড়ে থাকা সচিত্র চায়নিজ মেন্যুকার্ডটি টেনে নিয়ে ছবি দেখে খুব ধীরে সুস্থে দুই পুত্রের জন্য ওদের দাবিকৃত দুটো ডাবল উফার মিলের আর আমাদের তিনজনের জন্য নরমাল বার্গার মিলের অর্ডার দিতে দিতে নজর রাখলাম, ক্যাশমেশিনের পর্দায় ভেসে উঠা দাম নির্দেশক সবুজ অংকগুলোর দিকে, যাতে অন্তত দাম দেখে বুঝতে পারি ঠিকঠাক মতো অর্ডার নিচ্ছে কি না? অদ্ভুত ব্যাপার হলো মেন্যু কার্ডের সব লেখা চায়নিজ হলেও, দামগুলো কেন জানি ইংরেজিতেই আছে। জানি না যদিও এটা কেন এমন, তবে এতে আমার সুবিধাই হয়েছে। অন্তত দাম দেখে বুঝতে পারছি, যে কি দেখালাম তাকে আমি দেহভাষায়, আর বুঝল টা কী সে।

আচ্ছা চায়নিজ ভাষায় এই অংক বা সংখ্যা কীভাবে লেখা হয়? বলতে পারা, পড়তে পারা ও লিখতে পারার সক্ষমতার বিচারে আমরা সবাই দ্বিভাষিক। তদুপরি না বুঝে একটু আধটু আরবিও পড়তে পারি সবাই। তবে সংখ্যা বা অংক কিন্তু এর বাইরে রোমানও বুঝি টুকটাক আমি। আরবি অংকগুলোও চিনি মোটামুটি, কিন্তু চায়নিজ অংকে ধরা যাক কীভাবে ১২৫ লেখা হয় তা তো জানি না! যদিও জানি গোটা চায়নিজ ভাষাটাই আমার কাছে হায়ারোগ্লিফিক, তারপর এখন এ কথা মনে হতেই নিজের এই অজ্ঞতায় নিজেই অবাক হলাম।

সে যাক অর্ডার নেয়া শেষ হতেই, দাম মেটানোর জন্য পকেটে হাত দিতেই কাউন্টারে রাখা ক্রেডিট , ডেবিট কার্ডে দাম মেটানোর পজ মেশিন নামের যন্ত্রটি চোখে পড়তেই মনে হল, কি দরকার ক্যাশ খরচ করার। থাকুক ওসব হাতের পাঁচ হিসাবে। বরং ক্রেডিট কার্ডেই দাম মিটাই। এ ভেবে, ক্রেডিট কার্ড বের করে কাউন্টারের কিশোরটির দিকে এগিয়ে ধরতেই দেখি, ওটার দিকে তাকিয়ে সে এক্কেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মানে কী এর ? সে কি ক্রেডিট কার্ড চেনে না নাকি ? না ই যদি চিনবে তবে ঐ পজ মেশিনটা আছে কেন ওখানে ?

এরই মধ্যে দ্রুত নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে উঠে কিশোর পজ মেশিনটি হাতে নিয়ে ওটি ঘুরিয়ে আমার চোখের সামনে ধরতেই, ধরে নিলাম ও বোঝাতে চাচ্ছে যে ওটা এক্কেবারি খাঁটি চায়নিজ ব্যাংকের চায়নিজ মেশিন। এতে অন্য কোনো দেশের ক্রেডিট কার্ড চলবে না হোক না তো যতই আন্তর্জাতিক বাইক্কা মানে ক্রেডিট কার্ড! সাথে সাথেই মনে হল, আসলেই! হয়তো এখানকার এই মহাপ্রাচীর ঘিরে যে ভ্রমণ ব্যবসার আয়োজন করা হয়েছে, তার মূল লক্ষ হলো মূলত চায়নিজ ভ্রামণিকরাই। আমাদের দেশে এখনো ঐ বাইক্কা কার্ডে যতো বেচাকেনা হয়, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি হয় নগদ টাকায়, একই অবস্থা চায়নাতেও নাকি? তাহলে তো এ বিষয়ে চায়না আর আমরা আছি একই কাতারে।

এর বিপরীতে তথাকথিত উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো এরই মধ্যে পুরাপুরি ক্যাশলেস লেনদেনে আত্মস্থ করার পথে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। নগদানগদি লেনদেন বাদ দিয়ে ক্যাশলেস সোসাইটি বা বাইক্কা কার্ড নির্ভর সমাজ বিনির্মিণের পক্ষে তাদের থিওরি হল, এতে ব্যবসায়ে গতি বাড়বে। আর ভোগবাদী পূঁজির সমাজে ব্যবসাই তো হলো সবকিছুরই মূলচালিকা শক্তি। সমাজের, জীবনের গতিপ্রকৃতি যেহেতু আজ হয়ে পড়েছে বাণিজ্য নির্ভর, সেহেতু বাণিজ্যের গতি বাড়লে অবশ্যই তাতে বাড়বে গতি সমাজের ও মানুষের যাপিত জীবনের। এছাড়া আজকাল তো এক সময়ের টাইম ইজ মানি কথাটি পরিণত হয়েছে স্পিড ইজ মানিতে। মানে গতিতে অর্থলাভ। তদুপরি এ বিষয়ে তাদের আরকেটা যুক্তি হলো, এতে সমাজে দুর্নীতি, অপরাধ এসবও কমবে।

আমাদের দেশে কথা আছে, টাকায় কারো নাম লেখা থাকে না। অতএব এই টাকা দিয়ে কোনো অপরাধ সংঘটিত করা হলে, বা কাউকে ঘুস হিসাবে নগদ টাকা দিলে, তা প্রমাণ করা দুরূহ। এই সমস্যার সমাধান তারা খুঁজে পেয়েছে এই বাইক্কা কার্ডে। ফলে পশ্চিমাদের মূল ভরসা এখন এরই উপর। যার মানে হল, ওরা তো এখানে এসে তবে পড়বে মহাযন্ত্রণায়। আচ্ছা হাড়ে হাড়ে ব্যবসায়ী চায়নিজরা কি এটা বুঝে না? নাকি তারা তাদের ব্যাংকিং সিস্টেমে পশ্চিমা অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য ঐদিকে পা বাড়ায়নি? নাকি জ্যাত্যভিমানি চায়নিজরা যেহেতু কাগুজে টাকা আবিষ্কার করার প্রথম জাতি, সে হিসাবে তারা সেই ঐতিহ্য কে আঁকড়ে রাখতে চায় এখনো?

এসব ভাবতে ভাবতে অবশেষে আমার অচল আন্তর্জাতিক বাইক্কা কার্ডটি পকেটস্থ করে, নাগদানগদি দাম মিটিয়ে ভাবলাম বসি গিয়ে টেবিলে। এই ফাস্টফুড বা ত্বরাখাবারের দোকানগুলোতে সাধারণত একজন ক্রেতার হাতে তার অর্ডার দেয়া খাবার তুলে দিতে কম পক্ষে তিন থেকে চার মিনিট সময় নেয়। সে হিসাবে আমাদের পাঁচজনের খাবার ট্রে তে তুলে দিতে, ধরে নিচ্ছি এদেরতো কমপক্ষে পনের মিনিট লাগবেই। এ মুহূর্তে এখানকার ক্রেতাশূন্য এই অবস্থায় এখানকার কাউন্টার ও রসুই ঘরের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে, যে ঢিলেঢালা ভাব ভর করেছে, তাতে মনে হচ্ছে সময় নেবে এরা আরো বেশি। অতএব এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিব্রত করার চেয়ে টেবিলে গিয়ে বসাই ভাল। এ ভেবে অভ্রকে নিয়ে ঘুরে টেবিলের দিকে রওয়ানা করার সময়ে নজরে এলো কাউন্টারের একদম ডান দিকের দেয়ালে একটা রেকে বেশ কিছু চায়নিজ ও ইংরেজি মানে দ্বিভাষিক লিফলেট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো এদের খাওয়ার মেন্যুর লিফলেট না। ওগুলো কী তা জনার জন্য ঐদিকে এগিয়ে দ্রুত একটা লিফলেট হাতে নিয়ে টেবিলমুখো হলাম।

ফিরে এসে চেয়ারে বসতেই বুঝলাম, আবহাওয়া কিছুটা গুমোট। মুখ ভার করে ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে দীপ্র মায়ের মুখোমুখি। আমি এসে হাজির হতেই জেদি কাঁদো কাঁদো স্বরে যা জানালো ও, তাতে বুঝা গেল আমাদের অনুপস্থিতিতে কাউকে না বলে ওর ঐ কে এফ সি অভিযানের কারণে মায়ের বকা খেয়েছে সে। এ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থন করা তার বক্তব্য হল, এখানে তো লোকজনও নেই। আবার রাস্তা হারানোর কোনো ভয় নেই। তাই এক ফাঁকে সে ওখানে যাওয়াতে কী অমন ক্ষতি হয়েছে?

শোন, ঐ কথা বাদ দাও। আমি তোমাকে বাথরুমে গিয়ে ভালো মতো হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলেছি, তাও তুমি শুনছো না। আর এই অভ্র তুমি যে টয়লেটে গেলে, হাতমুখ ধুয়েছো কি ? আর তোমাকে বলছি তুমি কি অভ্রকে বলেছিলে হাত মুখ ধুয়ে নিতে। সারাক্ষণ যে ওরা বরফ আর ইট পাথর নাড়া চাড়া করলো দেখনি তুমি ওটা’?

এভাবে ছেলেদের মায়ের বন্দুকের নল এই কেষ্টা বেটার দিকে অনিবার্য নিয়মে ঘুরে যেতেই, দ্রুত জানালাম যে, মুখ না ধুলেও হাত অবশ্যই খুব ভালো করে ধুয়েছে অভ্র আমারই সাথে, রুটিন মাফিক প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি শেষে। একবার ভাবলাম এরই সাথে বলি, এখানে মুখ ধোয়ার দরকারটা কী? সাথে সাথেই মনে হল অকারণ কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। থাকুক মুখ বন্ধ তাতে ক্ষতি কী। তর্কে জেতার চেয়ে টেবিলে শান্তি বজায় রাখাই বরং গুরুত্বপূর্ণ। লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুষ্পকথা
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এবং মায়াকানন