পানিই জীবন, পানিই মরণ

মো. দিদারুল আলম | সোমবার , ২০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

‘Water, water everywhere, nor any drop to drink S.T. Coleridge এর The Rime of the Ancient Mariner কবিতার এই লাইনদ্বয় দ্বারা লবণাক্ত পানির বিশাল ভাণ্ডারের তুলনায় সুপেয় পানির সীমিত প্রবেশাধিকারের কথা আমরা বুঝতে পারি। আবার আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় বৈশাখ মাসে বাংলার নদীসমূহে হাঁটুজল থাকার বর্ণনা এসেছে। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বর্ষাকালে এ নদীসমূহ তাদের প্রমত্তারূপে পরিণত হওয়ার কথা। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তাঁর ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় বলেছেন ‘আজিকের বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে, বেনুবনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে’ যেখানে বৃষ্টির পানির ফোঁটা প্রেমানুভূতি তৈরি করেছে অন্যদিকে তিনি তাঁর ‘আসমানি’ কবিতায় একটুখানি বৃষ্টি হলেই আসমানীদের ঘরে পানি গড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিদারুণ কষ্টের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

পানির কোনো বর্ণ নেই, স্বাদ নেই এরপরও পানি মানব জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের মধ্যে সম্ভবত অক্সিজেনের পরেই পানির অবস্থান তাই পানির অপর নাম জীবন। পানি একটি সার্বজনীন দ্রাবক কারণ পানির অধিকাংশ জৈব যৌগ এবং অজৈব যৌগকে দ্রবীভূত করার অসাধারণ ধর্ম রয়েছে। এটি কঠিন অবস্থায় বরফ, তরল অবস্থায় পানি এবং বায়বীয় অবস্থায় জলীয় বাষ্প। পৃথিবীর নানা প্রান্তে পানি নিয়ে চলমান বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে হয়তো একদিন পানি দিয়ে গাড়ি চালানোর উপায় উদ্ভাবিত হবে।

গণিতের শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রায় বলেন অংকটি পানির মত সহজ। রাজনীতিতে প্রায় শোনা যায় ঘোলা জলে মাছ শিকারের কথা। জ্ঞানীদের মুখে শোনা যায় সাঁতার শিখতে হলে আগে জলে নামার কথা। বাংলায় উভয় সংকট অর্থে ব্যবহৃত হয় জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। ভীষণ বিপদে থাকার অর্থে অথৈই জল ব্যবহার করা হয়। উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বিভাগের শিক্ষকদের প্রশ্ন নারিকেল গাছের শিরে এতগুলো ডাবে পানি (লিকুইড এন্ডোস্পার্ম) অভিকর্ষের বিপরীতে এল কিভাবে? খেজুর গাছের আগায় এত রসের জোগান কোথায় থেকে? যেখানে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের আধুনিক পাম্পের সাহায্যে পানি বুস্টিং করে নর্থ খুলশি, পাহাড়তলী ইত্যাদি উঁচু এলাকায় পানি সরবরাহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে সেখানে উদ্ভিদের জাইলেম, ফ্লোয়েম টিস্যুর মধ্য দিয়ে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় অভিকর্ষের বিপরীতে পানির মাটির ভিতর হতে নারিকেল গাছের আগায় গমন সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। পদার্থ বিজ্ঞানে নিত্য পড়ানো হচ্ছে লোহার ছোট একটি টুকরা পানিতে ডুবে যায় অথচ লোহার তৈরি বিশাল জাহাজ পানিতে ভেসে বন্দর থেকে বন্দরে ছুটে চলার রহস্য।

রাখাইন সমপ্রদায়ের সর্ববৃহৎ উৎসব সাংগ্রাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ জলকেলি বা পানি খেলা। মুসলমানরা তাদের স্বজনদের জীবনের শেষ বিদায় জানায় গোসলের মাধ্যমে। সাধারণত বাঙালি বিয়েতে বিয়ের পূর্বে পাঁচ পুকুর বা সাত পুকুর হতে পাঁচ সখি গিয়ে কলসীতে পানি সংগ্রহ করে তা দিয়ে বর বা কনেকে গোসল করানো হয়। আমার মা আমাকে এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন ঘর হতে বের হওয়ার সময় আম গাছের ছোট একটি ডাল দিয়ে কলসী হতে সোনা রূপা মিশ্রিত পানি আমার মাথা ও শরীরে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত কারো বদ নজর না লাগার জন্য।

পানি পান না করে বেঁচে থাকা যেমন সম্ভবপর নয় তেমনি এই জীবন রক্ষাকারী পানি ক্ষেত্র বিশেষে জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিরও কারণ। পানিবাহিত নানা রোগের কথা আমাদের জানা আছে যেমনআমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি। পানির অভাবে যেমন ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে তেমনি অতিরিক্ত পানির কারণে সৃষ্ট বন্যা জনজীবনে দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়ায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা একদিকে পানি দিয়ে অগ্নিকাণ্ড থামায় অন্যদিকে সে পানিতে লঞ্চ ডুবির মাধ্যমে প্রাণ হারাতে হয় অনেককে। একদিকে পরিষ্কার পানির লেক যেমন মনের প্রশান্তির যোগান দেয় অন্যদিকে সে জমে থাকা স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে বর্তমান আতংক এডিস মশার জন্ম।

এক কাপ চাতে ও এক কাপ কফিতে ৯০ শতাংশের অধিক পানি ব্যবহার হয় তদ্রূপ এক গ্লাস জুস তৈরিতে উপাদান হিসেবে অন্যান্য উপাদানের তুলনায় পানির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। একটি খাবার স্যালাইন তৈরিতে আধা লিটার পানিতে কিছু চিনি ও যতসামান্য লবণ ব্যবহার করতে হয়। প্রায় সবকটিতে পানির ব্যবহার পর্দার আড়ালে থেকে যায়। অন্যদিকে ভারত বর্ষে সংঘটিত পানিপথের তিনটি যুদ্ধের মধ্যে কোনোটিই আসলে পানিতে সংঘটিত হয়নি।

১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস বাণিজ্যিক নৌপথ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেন। কলম্বাস, ম্যাগেলান ও ভাস্কোডাগামার মত নাবিকদের বিভিন্ন ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিদ্যমান সভ্যতাসমূহের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এর মাধ্যমে ক্রমশ পৃথিবীটা ছোট হয়ে এসেছে। পৃথিবীর যাবতীয় ভৌগোলিক আবিষ্কার সংঘটিত হয়েছিল পানিপথে। একটি মতানুসারে ৭ম শতকে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন আরাকান রাজ্যে আশ্রয় নেন। তাঁরা মনে করে আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। সেই রহম থেকেই আজকের রোহিঙ্গা। একইভাবে পর্তুগীজরা পানি পথে চট্টগ্রামে না আসলে হয়তো চট্টগ্রামে ফিরিঙ্গি বাজার নামক কোনো বাজার থাকত না । পানি পথ পৃথিবীর ইতিহাসে শাসন ব্যবস্থাসমূহ ওলট পালট করে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

আমার কর্মজীবনে প্রায় ৯ মাস প্রেষণে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় প্রায় মনে হতো আমার বেতন হয় ন্যায্যমূল্যে সুপেয় পানি বিক্রির টাকায়। একই সময়ে অনেকের রুজির ব্যবস্থা হতো হয়তো বৈধভাবে পরিচালিত বারে মদ বিক্রির টাকায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা পানি উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে পানি ব্যবসাতে এসেছে নানা বৈচিত্র্য। নগর জীবনে অন্য সকল ইউটিলিটি সার্ভিসের কোনো না কোন বিকল্প আছে কিন্তু পানির কোনো বিকল্প নেই। নগর জীবনের একটি দিনও পানি ছাড়া কাটানো সম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম মহানগরের অধিবাসীদের নিকট সুপেয় পানি সরবরাহের মেন্ডেট চট্টগ্রাম ওয়াসার। ২০০৯ সালের পূর্বে চট্টগ্রাম মহানগরে পানির তীব্র সংকটের কারণে কলসি মিছিল, ওয়াসা ভবন ঘেরাওয়ের মত ঘটনা ঘটেছিল। সে অবস্থা থেকে আজকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার যার প্রায় ৯২ শতাংশ ভূউপরিস্থ পানি পরিশোধনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির প্রতি ইউনিটের (১০০০ লিটার) আবাসিক মূল্য ১৮ টাকা এবং বাণিজ্যিক মূল্য ৩৭ টাকা ( প্রতিক্ষেত্রে ভ্যাট ও আইটি ব্যতীত)। অথচ বর্তমানে বাজারে বোতলজাত পানির প্রতি লিটারের বাজারমূল্য ২০৩০ টাকা। ২০১৮ সালে আমি নিজে অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে ৩০০মি.লি. পানি কিনেছিলাম ৩ অস্ট্রেলিয়ান ডলার দিয়ে তখন যা বাংলাদেশি টাকায় ১৮০ টাকা। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পসমূহে এককালীন বিনিয়োগ বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট পানির উৎপাদন খরচ প্রায় ২৮ টাকা। আমরা বাসা বাড়িতে যে পানি ব্যবহার করি তা কর্ণফুলী ও হালদা নদী হতে সংগ্রহ করে কঠিন পরিশোধনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সরবরাহ লাইনের ভিতর দিয়ে এবং বিভিন্ন স্তরে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পৌঁছানো হয়। এতকিছুর পরও আমরা অবহেলায় এই সম্পদের অপচয় করে থাকি। আমাদের পানি ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া উচিত। পুরো দেশে পানির বর্তমান যে অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বিদ্যুতের মত পানির জন্যও জাতীয় গ্রিডের প্রয়োজন হবে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পানির লাইনে লিকেজের মাধ্যমে প্রচুর পানি নির্গত হতে প্রায় দেখা যায়। এসময় আমরা চট্টগ্রাম ওয়াসার হেল্প লাইন নাম্বার ১৬১১৮ অথবা পানির বিলের মধ্যে সরবরাহকৃত চারটি মড অফিসের নাম্বারে একটি কল করে জানানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় এ সম্পদের অপচয় রোধ করতে পারি।

সবশেষে পানির পরিমিত ব্যবহারের একটি অসাধারণ উদাহারণ দিতে চাই। আমি ওয়াসায় কর্মরত থাকা অবস্থায় কাজীর দেউরীর ধোপা পাড়া এলাকায় প্রায় ৩৫ টি পরিবারের পানির কানেকশন পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকটি পরিবারের মাসিক পানির ব্যবহার ৩০ ইউনিটের কম অর্থাৎ ওয়াসার মাসিক মিনিমাম পানির বিলের নিচে। তারা যে পানিতে গোসল করে সে পানি বিশেষ ধরনের পাত্রে ধরে রেখে তা দিয়ে কাপড় ধোয়া ও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজসমূহ সম্পাদন করে থাকে। এই অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষদের নিকট হতে পরিমিতিবোধের বিষয়টি অনুসরণ করা যেতে পারে।

লেখক: নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধা বাগ্মীশ্বর একটি ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় শিশু দিবস ও শিশুর হৃদসুস্থতা