জাতীয় শিশু দিবস ও শিশুর হৃদসুস্থতা

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | সোমবার , ২০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ তার ‘সন্ধ্যের পরে’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘বসন্তের পাখির চিকন গলায় ডাকের মতো, বৈশাখের ভোরের হাওয়ার মতো, শ্রাবণের ঘনঘোর দুপুরের বৃষ্টির মতো শিশুরাও বিধাতার আশ্চর্য দান।’ বিধাতা প্রদত্ত এই দান বঙ্গবন্ধু সম্যক উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল অপরিসীম। তিনি শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। তিনি তার জন্মদিন ১৭ মার্চ অনাড়ম্বরে পালন করলেও এই দিনে তিনি শিশুদের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করতেন। এই দিনে শিশুরা দল বেঁধে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যেতো। এই সব বিবেচনায় তাঁর জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালন করা হয়। তবে ১৯৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রয়াত শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিম বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার জাতীয় সম্মেলনে এই দিবসকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালনের প্রস্তাব করেন। সম্মেলনের প্রধান অতিথি, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ১৯৯৭ সাল থেকে তা পালিত হয়ে আসছে। ১৯২০ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু তদানিন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম খোকা। পরবর্তীতে খোকা নামের এই শিশুটিই হয়ে উঠল নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা ও মুক্তির দিশারী। কিশোর বয়সেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালে তৎকালীন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন। উল্লেখ্য, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুও শিশুদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। ১৯৬৪ সালে তার মৃত্যুর পর তার জন্মদিন ২৭ মে ভারতের শিশুদিবস হিসাবে পালিত হয়।

আজকের শিশুই সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠে আগামীতে দেশের হাল ধরবে। জাতীয় শিশু দিবস পালনের মাধ্যমে সকল শিশুকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সকলকে সচেতনতার বার্তা দেয়া হয়। এদিনে শিশুর অধিকার সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা হয়। শিশুরা যাতে সঠিক শিক্ষা পায়, দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে পারে, তাদের মধ্যে যাতে দেশপ্রেমের স্ফুরণ ঘটে তার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করার দিন জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধুর ৫৬ বছরের জীবন অসামান্য গৌরবের। ছাত্রজীবন থেকে শুরু হয়ে আমৃত্যু তা বিস্তৃত। তাঁর দেশপ্রেম, মানব প্রেমের আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিটি শিশুর মধ্যে বিকশিত করে তাদের মানসিক উৎকর্ষ ও চারিত্রিক দৃঢ়তা তৈরী করা জাতীয় শিশুদিবস পালনের মূল প্রতিপাদ্য।

তবে এইসব অর্জনের জন্য আবশ্যক হচ্ছে শিশুর পুষ্টি ও সামগ্রীক শারীরিক সুস্থতার দিকে নজর দেয়া। আর শারীরিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে শিশু বয়সে হৃদরোগ মুক্ত থাকা।

শিশুদের হৃদরোগ:- শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষতার পূর্বশর্ত হচ্ছে হৃদসুস্থতা। এ বয়সে হৃদরোগ শৈশব ও কৈশোরের আনন্দ উচ্ছ্বাস কেড়ে নেয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এক সময় তারা পরিবার ও সমাজের কাছে হয়ে পড়ে বোঝাস্বরূপ। অপরদিকে হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান, যেমন অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ইত্যাদি শিশু কিশোর বয়সেই শুরু হয়। এগুলো প্রতিরোধ করে ভবিষ্যতে হৃদরোগের আশঙ্কা মুক্ত থাকার তখনই উপযুক্ত সময়।

জন্মগত হৃদরোগ:- এটাই এ বয়সে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শিশুদের জন্মগত ত্রুটির শতকরা ২৫ ভাগই জন্মগত হৃদরোগ। সাধারণভাবে প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ৮ জনের এ ধরনের জন্মগত হৃদরোগ হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় তা প্রতি হাজারে ২৫ জনের মধ্যে পাওয়া গেছে। জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। অপারেশনের মাধ্যমে তা সারাতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এদেশে জন্মগত হৃদরোগের উচ্চ প্রকোপ এবং তার ব্যয় বহুল চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এই রোগের চিকিৎসায় আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। উপযুক্ত গর্ভকালীন শুশ্রূষা ও উন্নত রোগ নিরূপণ ব্যবস্থা গ্রহণে তা বহুলাংশে প্রতিরোধ সম্ভব।

বাতজ্বর জনিত হৃদরোগ:- সাধারণত ৫১৫ বছর বয়সে তা হয়ে থাকে। গলায় জীবাণু সংক্রমণ জনিত টনসিলের প্রদাহর পরবর্তী জটিলতা হিসাবে তা হয়ে থাকে। এতে হৃদযন্ত্রের ভাল্ব ক্ষতিগ্রস্ত হল। স্বাস্থ্য শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও উপযুক্ত এন্টিবায়োটিক সেবনের মাধ্যমে গলাব্যথার চিকিৎসায় এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। সুখবর হচ্ছে, এদেশে এ রোগের প্রকোপ বর্তমানে নিম্নমুখী। এটি আর্ত সামাজিক অগ্রগতি ও চিকিৎসা সেবার উন্নতির সুফল।

করোনারী হৃদরোগ:- এনজিনা, হার্ট অ্যাটাক প্রাপ্ত বয়স্কদের অসুখ হলেও তার বুঁকিপূর্ণ দিকগুলো শৈশব ও কৈশোরে শুরু হয়। মেদ বাহুল্য, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অলস জীবন যাপন, ধূমপান এগুলো এই রোগের স্বীকৃত বুঁকিপূর্ণ উপাদান। শিশু বয়স থেকে এগুলো পরিহার করে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস গড়ে তুললে ভবিষ্যৎ হৃদরোগ প্রতিরোধ সম্ভব।

মেদ বাহুল্য:- শৈশব থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়। পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, অলস জীবনযাত্রা, ব্যায়ামের অভাব ও খেলাধুলার সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে বর্তমানে শিশুরা মেদবাহুল্য হয়ে পড়েছে। শৈশবের মেদবাহুল্য প্রাপ্ত বয়সে হৃদরোগের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। মেদবাহুল শিশুদের প্রাপ্ত বয়সে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা অন্যদের তিন গুন। এই মেদবাহুল্যই কম বয়সে ডায়াবেটিস সৃষ্টি করেছে। এটা রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরলের সাথেও সম্পর্কিত, যা হৃদরোগের প্রধান কারণ

অলস জীবনযাত্রা ও ব্যায়ামের অভাব:- শিশু কিশোররা স্বভাবতঃ প্রাণবন্ত ও কর্মমুখর। বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা মেদবাহুল্য সৃষ্টি করছে। নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলার সুযোগের অভাব, হাঁটা ও সাইকেল চালানোর সুযোগ সংকুচিত হওয়া, যানবাহনের উপর অতিমাত্রার নির্ভরতা জীবনযাত্রাকে অলস করে তুলেছে। এতে বাড়ছে মেদবাহুল্য ও হৃদরোগের ঝুঁকি।

খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন :- উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার (যেমন চিপ্‌্‌স) হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে অনেকগুণ। শিশু বয়সের এই পরিবর্তিত খাদ্যভ্যাস এদেশে হৃদরোগের ক্রমবদ্ধমান প্রকোপের জন্য অনেকাংশে দায়ী।

ধূমপান:- প্রায়ক্ষেত্রে এই অভ্যাস শৈশবে গড়ে উঠে। অন্তত শতকরা ৩০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী তাদের সিগারেটের প্রথম টান শৈশবে দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও ডেম্মোগ্রাফী জরিপে দেখা যায় ধূমপানের প্রবণতা কমবয়সীদের মধ্যে বাড়ছে। তাই শিশু বয়স থেকে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে সচেতনা সৃষ্টি জরুরি। শিক্ষকগণ শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে ভূমিকা রাখবেন। ধূমপানের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরবেন। বাবামা কোন অবস্থাতেই সন্তানের সামনে ধূমপান করবেন না। শিশুরা যাতে সিগারেট কোম্পানীর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যত। তারাই ভবিষ্যতে এই দেশকে এগিয়ে নেবে। তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে বেড়ে উঠার উপর অনেকটাই নির্ভর করে দেশের অগ্রগতি।

লেখক: মহাসচিব, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান,

হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধপানিই জীবন, পানিই মরণ
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়তলী অলিম্পিক বার ফুটবল টুর্নামেন্টে খাগরিয়া একাদশ চ্যাম্পিয়ন