বীর মুক্তিযোদ্ধা বাগ্মীশ্বর একটি ইতিহাস

সুপ্রতিম বড়ুয়া | সোমবার , ২০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘদিন ধরেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারী নিয়ে লিখবো বলে পরিকল্পনা করে বসে আছি। কিন্তু কোনো ভাবেই সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। যদি তার সম্পর্কে ঠিকমত লিখতে না পারি! এই ভয়টা সব সময়ই কাজ করতো। আমি যাকে নিয়ে লিখছি তাদের উত্তরসূরিও আমরা তবুও ভয় হয় যদি তাকে নিয়ে ঠিকমত লিখতে না পারি। তবে ভয়কে জয় করাটাও তার কাছ থেকে শিখেছি। তাঁর সম্পর্কে কিছু বই পড়ে।

কীভাবে ভয়কে জয় করে দেশ রক্ষা করতে হয়, কীভাবে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয় তা এই মহামানুষটির কাছ থেকেই শিখেছি দূর থেকে হলেও। তবে আজ আমি যা লিখবো তা শুধু আপনাদের ইমোশনকে বা আপনাদের হৃদয়ে ব্যথা দেয়ার জন্যই লিখবো। এই ব্যথাটা আপনাদের পাওয়ার দরকার আছে। যে মানুষটিকে নিয়ে লিখবো বলে কথা বলছি সেই মহা মানুষটির নাম শহীদ বাগ্মীশ্বর। বাগীশ্বর যুববিদ্রোহের নেতা ও মহান বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের অনুসারী একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে। তিনি ছিলেন মাবাবার একমাত্র সন্তান। তার বাল্যনাম ছিল ‘শশাংক মোহন বড়ুয়া। বাগ্মীশ্বর তার মামাতো ভাই রুহিনী বড়ুয়ার মাধ্যমে সূর্যসেনের বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কিশোর বয়সেই তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার নির্যাতিত হন। একবার তার হাতের আঙুলের নখে সুঁচ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ১৯৩২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে লাল তালিকাভুক্ত অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৩৫ সালে তাঁর ভাই রুহিনী বড়ুয়ার ফাঁসির খবর শোনার পর বাগ্মীশ্বর মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান এবং গোপনে বিপ্লবী কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা চলে যান। গোপনে বিপ্লবী কাজ পরিচালনার জন্য তিনি ত্রিচীবর বা গেরুয়া বেশ গ্রহণ করেন। এ সময় তার নাম হয় বঙ্গীশ ভিক্ষু। বাগ্মীশ্বর ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে আই. . পাস করেন। বাগ্মীশ্বর ১৯৪১ সালে পালি সূত্র বিশারদ উপাধি পান। তিনি ১৯৪৬ সালে বি, . এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বি. এড, পাস করেন। ১৯৪৯ সালে বাগীশ্বর এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মিলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘগড়ে তোলেন। বাগীশ্বর ওই সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনে বাগীশ্বর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৪ সালে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত ‘ষষ্ঠ সংখ্যায়নাতে’ তিনি একজন প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ভারতে, ১৯৫৯ সালে জাপানে এবং ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ঢাকার কমলাপুরে জাতীয় বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল শুরু হলে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে বাগ্মীশ্বর মর্মাহত হন। অন্তঃকোন্দল শুরু হলে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে বাগ্মীশ্বর মর্মাহত হন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে স্বার্থপরতা এবং রেষারেষির কারণে অত্যন্ত মনোকষ্ট নিয়ে তিনি ত্রিচীবর ত্যাগ করেন। পরে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। তিনি চন্দ্রঘোনা নারাণগিরি পাইলট হাই স্কুল, চট্টগ্রামের কাটিরহাট হাই স্কুল, সফরভাটা উচ্চ বিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলেও তিনি কিছুদিন পালি শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। বাগ্মীশ্বর চট্টগ্রাম রেঞ্জের স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৬৯ সাল থেকেই বাগ্মীশ্বর স্বাধীনতার পক্ষে তৎপর ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কাপ্তাইতে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়, যার নেতৃত্বে বাগীশ্বরও ছিলেন। অবাঙালিদের হামলা ঠেকাতে কলোনিতে প্রতি রাতে পাহারা বসাতেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকবাহিনী কাপ্তাইয়ে ঢোকে। বিপদের আশঙ্কা থাকলেও তখন কাপ্তাই থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। শহীদ বাগীশ্বরের নামে কাপ্তাইতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রিসিপশন গেইটে কাপ্তাইয়ের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবীদের নামফলক রক্ষিত আছে। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রবেশের মুখে চোখ আটকে যায় সেই নাম ফলকের দিকে। অবনত চিত্তে মনের মধ্যে শ্রদ্ধা চলে আসে সেই সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম দেখলে। সেই নাম ফলকে ২৮ নাম্বার সিরিয়ালে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে কাপ্তাই এর বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার নাম। কিন্তু সরকারি তালিকায় নাম নেই। পরিবারের দাবি সরকারি তালিকাভুক্তির। কে সেই বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া? তাঁর ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে পিছনের দিকে। কাপ্তাই প্রজেক্টের কর্ণফুলি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়) প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকবাহিনী কাপ্তাইয়ে প্রবেশ করে। সেই সময় বিপদের কথা মাথায় রেখে শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ২০ মে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে চলে যান। সেইখানে তিনি গ্রামের যুবকতরুণদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং সকলকে যুদ্ধে যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এরপর তিনি ১৯৭১ এর ১৩ জুন আবারও তাঁর কর্মস্বল কাপ্তাই প্রজেক্টে চলে আসেন। এরপর তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে আর খুঁজে পাননি। দেশ স্বাধীন হবার পর তারা জানতে পারে কাপ্তাইয়ের শান্তি কমিটির লোকজন তাঁকে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেন। ধারণা করা হয় জুন মাসে তিনি কাপ্তাই এ পাকবাহিনী হাতে শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিশোর বয়সে তিনি ছিলেন বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেনের কিশোর কর্মী। সেই কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রেকর্ডপ্রাপ্ত আসামি ঘোষিত হবার প্রেক্ষিতে আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে বঙ্গীশ নাম দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে বিপ্লবী কার্যক্রম চালিয়ে যান তিনি। ৩২৯জন বুদ্ধিজীবীর জীবনী নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ এ উনার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। এইছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ৭১ এর ৫ম খণ্ডে উনার ৭১ এর স্মৃতির কথা লিখা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত এক চিঠিতে তাঁর পরিবারের উদ্দেশ্যে লেখা পত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা প্রশংসা করা হয় এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম ছিল শশাংক মোহন বড়ুয়া। ১৯৪৯ সালে তিনি এবং বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় গুরু প্রয়াত বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মিলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ গড়ে তোলেন। তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়ে ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম আর্ন্তজাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ সম্মেলনে তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৭ সালে কর্ণফুলি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে কাপ্তাইয়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কাপ্তাইয়ে এক বিশাল মশাল মিছিল বের হয়। অথচ ৭১ এর রণাঙ্গনের এই অকুতোভয় সৈনিক শিক্ষাবিদ এখনো সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা পাননি। আমাদের ব্যথা ঐ জায়গায়। আমরা চাই তাঁকে সরকারিভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তালিকাভুক্ত করা হোক। তরুণ প্রজন্ম কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এখনই সংরক্ষণ করা না হলে তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে যাবে, তাই আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তথ্য যাচাই বাছাই করে তাদের অবদান জাতির কাছে তুলে ধরার আহবান জানাচ্ছি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুমিই বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধপানিই জীবন, পানিই মরণ