ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে মশার লার্ভা নিধন সম্ভব

২৫০টি উদ্ভিদ নিয়ে চবি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষকের গবেষণা ১৯টিতে শতভাগ ও বাকিগুলোতে বিভিন্ন হারে লার্ভা মারা যায়

মোরশেদ তালুকদার | শুক্রবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

পূর্ণাঙ্গ মশা মারতে এবং মশার লার্ভা ধ্বংসে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নগরের নালানর্দমায় কীটনাশক ছিটায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু কমে না মশার উৎপাত। একইভাবে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে বাসাবাড়িতে মানুষ বিভিন্ন কোম্পানির কয়েল এবং স্প্রে ব্যবহার করে। এতেও শতভাগ সুফল মিলে না। উল্টো মশা মারার কীটনাশকে থাকা বিভিন্ন রাসায়ানিক উপকরণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যকে হুমকিতে ফেলছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে মশার লার্ভা নিধনে সাফল্য পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। তারা ২৫০টি ওষধি উদ্ভিদের নির্যাস নিয়ে গবেষণা চালায়। এর মধ্যে ১৯টি উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের নির্যাস প্রয়োগে দেখা যায়, মশার শতভাগ লার্ভা নিধন হয়েছে। যার মধ্যে আবার কয়েকটি উদ্ভিদের নির্যাস প্রয়োগের ২ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যেই শতভাগ লার্ভা নিধনের কার্যকারিতা পরিলক্ষিত করে গবেষক দলটি। শতভাগ লার্ভা নিধনে সাফল্য আসা ১৯টি উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছেসর্পগন্ধা, বনগাঁদা, ফুলকুড়ি, নাকফুল এবং গোল মরিচ।

গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। গবেষণায় সহযোগী ছিলেন চবি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান ১১ জন শিক্ষার্থী। তারা হচ্ছেনমো. সোহাগ হোসেন, শরীফুল ইসলাম, মো. ইসমাইল, খায়রুল ইসলাম ইভান, মো. ইকরামুল হাসান, সানজানা চৌধুরী নাহিন, মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, মো. আরিফ হোসাইন ও সনাতন চন্দ্র বর্মন।

গবেষক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল আজাদীকে বলেন, তিন বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা চালানো হয়। এই গবেষণা মশা সংক্রমণ ও ব্যবস্থাপনায় নতুন দিক সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি উন্মুক্ত করতে সহায়ক হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গবেষণায় মশার লার্ভা নিধনে সাফল্য পাওয়া উদ্ভিদগুলোর কিছু সহজলভ্য এবং কিছু দুর্লভ। গবেষণাকর্মের ফলাফল কাজে লাগিয়ে মশার লার্ভ নিধনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন বা অন্য কোনো সংস্থা এগিয়ে আসতে পারে। বাণিজ্যিকভাবেও এটার ব্যবহারে এগিয়ে আসা উচিত।

গবেষণার ফলাফল : গবেষক দল জানায়, প্রাথমিকভাবে ৭৭ টি বিভিন্ন গোত্রের ২৫০টি উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের নির্যাস প্রয়োগ করা হয় এডিস, কিউলেঙ এবং অ্যানোফিলিস মশার লার্ভার উপর। এর মধ্যে ৭৭ টি বীরৎ, ৫৯টি গুল্ম, ৫৭টি কাষ্ঠল উদ্ভিদ এবং ২৪ টি লতা ছিল। এর মধ্যে ৫৫ টি উদ্ভিদের নির্যাসে মশার লার্ভা নিধনের হার ছিল ৫০ শতাংশের বেশি।

এছাড়া চারটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের নির্যাস প্রয়োগ করে ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার লার্ভা নিধন হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুইটি প্রজাতি হলোমরিচা ফুল এবং তিত বেগুন। একইসঙ্গে লাল ভেরেন্ডা, নিশিন্দা, নিম এবং সাদাচিতাসহ পাঁচটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের নির্যাস দিয়ে ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ মশার লার্ভা নিধন হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, নির্যাস ব্যবহার করা ২৫০ উদ্ভিদের মধ্যে ভাট ও কাসাভাসহ ছয়টি উদ্ভিদ ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ, কালমেঘ, শ্বেতদ্রন, লেবু ও টমেটোসহ ১০টি উদ্ভিদ ৬০ থেকে ৬৯ শতাংশ এবং কুরমুতা, চায়না টগরসহ ১১ টি উদ্ভিদ ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ মশার লার্ভা নিধনে কার্যকর।

গবেষক দল মনে করেন, গবেষণায় মশার লার্ভা নিধনে কার্যকর হিসেবে চিহ্নিত গাছের প্রজাতিগুলি ব্যবহার মাধ্যমে নতুন এবং কার্যকরী মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তৈরি হতে পারে। এমনকি ভবিষ্যতে মশক নিয়ন্ত্রণেও নতুন ও কার্যকরী পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে সুদূর প্রসারী ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া নিরাপদ পদ্ধতির উদ্ভাবনের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং অন্যান্য মশা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য হতে পারে। গবেষণার ফলাফল মশা সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে এবং মশা নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী পদক্ষেপ গ্রহণে সাহায্য করতে পারে। এই গবেষণার ফলাফলে ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সংরক্ষণে নতুন এবং কার্যকরী পদ্ধতি উদ্ভাবন হতে পারে।

জানা গেছে, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) মশার কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। ওই সময় চসিক পূর্ণাঙ্গ মশক নিধনে ফগার মেশিন দিয়ে লিকুইড এডালটিসাইড (ল্যামডাসাইহ্যালোথ্রিন ও ডেল্টামোথ্রিনের মিঙার) কীটনাশক এবং মশার লার্ভা নিধনে স্প্রে করে ‘এম ফস ২০ ইসি (ক্লোরপাইরিফস)’ নামের লার্ভিসাইড ব্যবহার করত। ২০২১ সালের গবেষণায় দেখা যায়, লিকুইড এডালটিসাইড প্রয়োগের দুই ঘণ্টার পর মশার মৃত্যুর হার ছিল ১৯ শতাংশ। একইভাবে লার্ভিসাইড ছিটানোর দুই ঘণ্টা পর লার্ভার মৃত্যুহার ছিল ১৬ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, এডালটিসাইড কেরোসিন দিয়ে মিশিয়ে মারতে হয়। গবেষকদল কেরোসিন ছাড়াও প্রয়োগ করে। এতে মৃত্যুহার ছিল ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ চসিকের ব্যবহৃত এডালটিসাইড সরাসরি প্রয়োগেও মশক নিধনে খুব বেশি কার্যকর ছিল না। তখন গবেষক দল জানায়, কীটনাশকের অতিরিক্ত প্রয়োগ জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এবং মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে বলেও সর্তক করা হয়। ওই গবেষণাটিরও নেতৃত্বে ছিলেন ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল।

এ গবেষক বলেন, মশাবাহিত রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি। ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া, জিকা, চিকুনগুনিয়ার মতো জটিল রোগের সংক্রমণের জন্য দায়ী এডিস, কিউলেঙ, ও অ্যানোফিলিস মশার বাহক। বর্তমানে বিভিন্ন রাসায়নিক এবং কীটনাশক প্রয়োগ করার পরও মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো এইসব বাহক মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহারকৃত কৃত্রিম কীটনাশকের উচ্চ পরিচালন খরচ, কীটনাশকের প্রতি মশার শারীরবৃত্তীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, এবারে গবেষণাকর্মটির মূল উদ্দেশ্য ছিলএডিসসহ অন্যান্য মশার লার্ভার উপর ঔষধি উদ্ভিদের লার্ভিসাইডাল প্রভাব মূল্যায়ন, মশার লার্ভা নিধনে কার্যকরি পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ উপাদান সনাক্ত করা এবং লার্ভা নিধনের জন্য সর্বোত্তম ঘনমাত্রা নির্ধারণ করা। এছাড়া ডেঙ্গু রোগের মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়াকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘস্থায়ী এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান আবিষ্কার, রাসায়নিক লার্ভিসাইডের বিকল্প খুঁজে বের করা এবং কার্যকরি উদ্ভিদগুলোর নির্যাস প্রাকৃতিক মশার প্রজনন পরিবেশে প্রয়োগ এবং লার্ভা নিধনের কার্যকারিতা মাঠ পর্যায়ে মূল্যায়ন করা আমাদের উদ্দেশ্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার স্পেশাল ৩০ মে পর্যন্ত বর্ধিতকরণের সুপারিশ
পরবর্তী নিবন্ধমাছের উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানিতে পিছিয়ে দেশ