পবিত্র হজ্ব বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মহাসম্মেলন

ফারুক ইসলাম নোমানি | শুক্রবার , ৮ জুলাই, ২০২২ at ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক। মহান আল্লাহর বিধানানুসারে যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত তার একটি হলো জিলহজ্ব মাস। এ মাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশক। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এই দশকের বিশেষ ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং মহান আল্লাহ এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশ করে এই দশকের রাতগুলোর নামে শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-শপথ ভোরবেলার শপথ দশ রাত্রির। (সূরা : ফজর আয়াত : ১-২)।
হজ্ব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা বা সংকল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনার্থে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত তারিখে, নির্দিষ্ট স্থান তথা কাবা শরীফ ও তৎসংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করার সংকল্প করাকে হজ্ব বলা হয়। হজ্ব একটি বার্ষিক বিশ্ব-মুসলিম মহাসম্মেলন। এই বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অতি সহজেই একই সময় হাজীগণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা পৃথিবীতে। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবানদের ওপর জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ। হজ্বে রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নানাবিদ শিক্ষা। সে শিক্ষাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
আল্লাহর নির্দেশ পালন : হাজিরা হজ্ব আদায় করে মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবাগৃহে যাতায়াতের জন্য (দৈহিক ও আর্থিকভাবে) সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর হজ্ব করা ফরজ। (সুরা: আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন অনিবার্য প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী শাসক অথবা কঠিন রোগ যদি (হজ্বে সামর্থ্যবান) কোনো ব্যক্তিকে হজ্ব পালনে বিরত না রাখে, তবে সে যদি হজ্ব পালন না করে মারা যায়, সে যেন ইহুদি ও নাসারার মতোই মৃত্যুবরণ করে। (দারেমি)।
পবিত্র স্থানগুলোর দর্শন: পবিত্র মক্কা ও মদিনায় রয়েছে অগণিত পবিত্র স্থান। যেমন আল্লাহ তাআলার ঘর, হাজরে আসওয়াদ, মাকামে ইব্রাহিম সাফা-মারওয়া, আরাফার মাঠ, মিনা, মুজদালিফা, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, প্রিয় নবী (সা.)-এর রওজা মোবারক, জান্নাতুল বাকি, জান্নাতুল মুয়াল্লা, জমজম কূপ ইত্যাদি। এসব স্থান দেখার ফলে ইমান বৃদ্ধি পায়।
আর্থিক সফলতা লাভ : কেউ সারা জীবন পরিশ্রম করে অল্প অল্প সঞ্চয় করে এবং এখানে একই সময়ে ব্যয় করে ফেলে, কিন্তু সারা বিশ্বের ইতিহাসে কোথাও এরূপ ঘটনা দৃষ্টিগোচর হয় না যে কোনো ব্যক্তি হজ্ব বা ওমরাহর জন্য ব্যয় করার কারণে নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ তাআলা হজ্ব ও ওমরাহর সফরে এই বৈশিষ্ট্য নিহিত রেখেছেন যে হজ্ব করার পর কোনো ব্যক্তি দরিদ্রতা ও দীনতার সম্মুখীন হয় না। বরং হজ্ব ও ওমরাহ পালনে ব্যয় করলে দরিদ্রতা ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। (মাআরিফুল কোরআন)
পাপাচার থেকে বাঁচার সুযোগ : হজ্ব এমন একটি ইবাদত, যা হজ্বব্রত পালনকারীকে সর্বপ্রকার পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রাখে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্ব করে এবং তাতে অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ্ব থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে, অর্থাৎ নবজাত শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, হজ্ব পালনকারীও তদ্রূপ হয়ে যায়। (বুখারি ও মুসলিম)
বিশ্ব সম্মেলন : হজ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশ্ব সম্মেলন ও ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের বিশ্ব সম্মেলন অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় না। একমাত্র তৌহিদবাদী মুসলমানরাই পৃথিবীর দিক-দিগন্ত থেকে ছুটে আসে কাবা পানে। এখানে বর্ণ ও ভাষার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই এক কাতারে দণ্ডায়মান হয়ে একই কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকালাক। অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির,আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত আপনারই, আর সব সাম্রাজ্যও আপনার,আপনার কোনো শরিক নেই।
সমতার শিক্ষা : হজ্ব থেকে লাভ করা যায় সমতার শিক্ষা। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো ও নানা দেশের নানা ভাষী মানুষ ইহরাম অবস্থায় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাদা কাপড় পরিধান করে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করার এ দৃশ্য মমতা ও অভিন্নতার শিক্ষা দান করে। মানুষের মধ্যে আত্মগর্ব, হিংসা, সাদা-কালো চামড়ার বিভেদ, পরশ্রীকাতরাতা, ঘৃণা, পরনিন্দা প্রভৃতি থেকে মানুষকে দূরে থাকতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাই বলা যায় এই হজ্ব মুসলিম উম্মাহর সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বজনীন মানবতা বিকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম।
ত্যাগের প্রশিক্ষণ : আল্লাহর রাহে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.) ও হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম, কোরবানি, আত্মসমর্পণ ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুমহান ঐতিহ্য আল্লাহ প্রেমিক মানবের হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে। হজ্ব ও কোরবানি এ ত্যাগের শিক্ষা দেয়।
বিশ্বভ্রাতৃত্বে শিক্ষা : মহানবী (সা.) বলেছেন সব মুসলমান ভাই ভাই। তার জ্বলন্ত নিদর্শন হজ্বব্রত পালন। সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আরাফার মাঠে সব একত্রিত হয়। যেন সবাই একই মায়ের সন্তান। একই ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে একই স্রষ্টার কাছে দোয়া করে। হজ্ব বিশ্ব মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার করে। হজ্ব শেষ করে নিজ নিজ দেশে গিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে।
প্রশস্ত মনের অধিকারী হওয়ার সুযোগ : হজ্বব্রত পালনের মাধ্যমে হজ্বকারীর মনের সংকীর্ণতা দূর হয়ে যায়। কারণ দেশে ছিল নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে, এখন হজ্বে এসে বাইরের দেশের লোকদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ লাভ হওয়ার ফলে তার হৃদয় অনেক প্রশস্ত হয়ে যায়। এতে তার মধ্যে উদারতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, দয়ামায়া ও দ্বীনি রীতিনীতির প্রতি আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়।
আল্লাহর নিয়ামত লাভের সুযোগ : হজ্বব্রত পালনকারীদের ওপর আল্লাহর নিয়ামত বর্ষিত হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, যখন হাজিরা আরাফাতে অবস্থান করে দোয়া ও কান্নাকাটি করতে থাকে, তখন আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং ফেরেশতাদের বলেন আমার বান্দাদের দেখো, ওদের চুল এলোমেলো হয়ে আছে, পরিধেয় বস্ত্র ধুলাবালিতে মলিন। দেখো, ওরা এ অবস্থায়ই আমার কাছে চলে এসেছে। লোকেরা যখন আরাফাতে উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটি করে, তখন আল্লাহর তরফ থেকে তাদের জন্য বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। আর আল্লাহ তাআলার রহমতে আরাফার দিন অধিকসংখ্যক পাপীকে ক্ষমা করে দেওয়ার ফলে শয়তান খুবই ব্যথিত হয়।
মাগফিরাত ও তাওবা করার সুবর্ণ সুযোগ : আল্লাহ তাআলার ঘরের জিয়ারত ও আরাফা, মিনা, মুজদালিফা ইত্যাদি পবিত্র স্থান জিয়ারতের মাধ্যমে হজ্বব্রত পালনকারী আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও তাওবা করার সুযোগ লাভ করে। আল্লাহর ঘরকেন্দ্রিক সব স্থান ও আরাফা, মিনা, মুজদালিফা ইত্যাদি সব স্থানই দোয়া কবুল হওয়ার জায়গা। আর আল্লাহ তাআলা এসব স্থানে তাদের দোয়া কবুল করেন।
ঈমান নবায়ন করার সুযোগ : হজ্ব মুমিনদের ইমান নবায়ন করার ক্ষেত্র। হজ্ব আগত মুমিনদের অপূর্ব এক ইমানি চেতনায় উজ্বীবিত করে তোলে। হজ্বব্রত পালনকারী দুনিয়ার সব কিছু থেকে বিমুখ হয়ে একমাত্র আল্লাহমুখী হয়ে যায়। ফলে মুমিন পার্থিব লাভের চেয়ে পারলৌকিক লাভকেই প্রাধান্য দেয় এবং পারলৌকিক সুখশান্তির জন্য সদা কাজ করে। আর এতে তার ইমান তাজা হয়।
সমাপনী : হজ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশ্ব সম্মেলন এবং ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। ফলে ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর পবিত্র ঘর দেখা থেকে শুরু করে বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত প্রতিটি কাজই আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ, বিশ্ব মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির প্রশিক্ষণ। হজের মাধ্যমে একজন হাজি নিজেকে জান্নাতে যাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। তাই মহানবী (সা.) বলেছেন মকবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু না। (বুখারি ও মুসলিম)
এই বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে দুনিয়ার সব দেশ থেকে হজ্বযাত্রীরা সমবেত হন। সমসাময়িক যাবতীয় প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হয় এই পবিত্র হজ্বের মাধ্যমে। মুসলমানদের এক কাতারে শামিল হওয়ার এই সুযোগ কাজে লাগানো সময়ের দাবি। বিশ্ব মুসলিম নেতারা সেদিকে যত তাড়াতাড়ি নজর দেবেন ততই কল্যাণ।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধ্যবিত্তের নীরব কান্না
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা