দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

হি ইজ বাংলাদেশ

কথাটা বহুবারই শুনেছি জীবনে। বিশেষত পুত্র আমার আছে এখন যে বয়সে, সে একই বয়সে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়ে যাবার পর যে প্রবল ধাক্কাটি খেয়েছিলাম, তার পর পরই সেই পিতাকে নিয়েই তো চারদিকে চলছিল নানান মতলববাজদের শত রকমের মিথ্যাপ্রচারণা। তাতে তুমুল অক্ষম ক্রোধে ফুঁসলেও কখনো হতবাক হইনি, যেমন হলাম এখন!
নিজের শৈশব, বাল্য, কৈশোর, তারুণ্য যতোরকমের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অপরাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তার ছিটেফোঁটার তো মুখোমুখি হয়নি পুত্ররা আমার? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, দেশের ইতিহাস নিয়ে পুত্রদের সাথে প্রায়শই গল্প গুজব করলেও, রাজনৈতিক কোনো আলোচনা তো করিনি কখনো। কারণ ওরকম আলোচনা করার বয়সই তো হয়নি এদের। এছাড়া সারা পৃথিবীজুড়েই এখনকার এই প্রজন্ম তো হলো, রাজনীতি নিয়ে সচেতনভাবে অসচেতনই নয় শুধু, বলা চলে তুমুল বিমুখই এরা। নাহ শুধু বিমুখই নাই এরা, বরং এ ব্যাপারটাকে এ ডিজিটাল প্রজন্ম সোজা ভাষায় বলতে গেলে, বলতে হয় ঘৃণাই করে। যার কারণে খোদ পশ্চিমে এই প্রজন্মটিকে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা যখন ‘জেনারেশন জেড’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, তখন অনেকে তাদের ‘ফাক পলিটিক্স জেনারেশন’ ও বলে থাকে। সেই প্রজন্মেরই এক প্রতিনিধি যে নাকি আমারই আত্মজ, সে যখন এরকম একটি রাজনৈতিক মন্তব্য করে বসে তখন তো হতবাকই হতে হয়।
এসব ভাবতে ভাবতে ভাবলাম পুত্রকে জিজ্ঞেস করি বিশদ। বুঝতে চেষ্টা করি বঙ্গবন্ধু বিষয়ে করা তার মন্তব্যটির পেছনের যুক্তিটি। কিন্তু মুখ খোলার আগে, তখনই ওরা টেবিল ছেড়ে উঠে গেল ফুপ্পির ডাকে, লাল সবুজ এই নুডুলস বারের নানান মোক্ষম জায়গাকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে ছবি তোলাতুলির মজমায়।
ঠিক এসময় খাবারের ট্রে হাতে লালসবুজ ওয়েটার এসে সামনে দাঁড়াতেই, সম্বিৎ ফিরে পুত্রদের খোঁজে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি, দেখেছে তারাও যে টেবিলে হাজির খাবার। পেছনে এক কোনে রাখা বিশালাকার একটা কারুকার্যময় চায়নিজ ফুলদানী ঘিরে চলতে থাকা হেলেনের ছবি তোলাতুলি পর্বের আকস্মিক সমাপ্তি ঘোষণা করে দুজনেই তাই চলে এল ।
ওরা টেবিলে ফিরতেই, ওয়েটারকে হাতের ইশারায় বোজালাম, নুডুলসের খদ্দের হল পুত্ররা, আর আমার অর্ডার ছিল চিকেন সা’তে।
‘ওয়াও দিস ইজ হিউজ’। হ্যাঁ একটু কালচে রঙ্গয়ের টলটলে ঝোলের ভিতর হাবুডুবু খাওয়া নুডুলস ভর্তি ছোটখাট গামলা সাইজের জামবাটিটি সামনে পেতেই, চোখ বড় করে অভ্রর করা এই মন্তব্য এক্কেবারেই যথার্থ। দীপ্রর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে তার দেয়া অর্ডারের নুডুলস সামনে পেয়ে। মিন মিন করে বলল তাই
‘বাবা, তুমি কিন্তু আমাকে হেল্প করো। আমি কিন্তু এটা শেষ করতে পারবো না। দেখো না অভ্রর বাটিটার চেয়ে আমারটা আরো বড়’।
ঠিক আছে আগে খেতে তো শুরু করো। নাও আমার এখান থেকে চিকেন নাও দু’জনে। এই হেলেন তুই ও নে একটা।
‘এটা কি আসলেই চিকেন? অন্য কিছু না তো’! সন্দেহের দোলাচালে দোনোমনো করছে হেলেন। এদিকে পুত্ররা চিকেনের তোয়াক্কা না করে ঝাপিয়ে পড়েছে যার যার সামনের নুডুলসের গামলার উপর। ছুরি, কাঁটা চামচ, টেবিল চামচ, স্যুপ চামচ এসব টেবিলে আগে থেকেই সাজানো থাকলেও, রোমে গিয়ে রোমানি হতে হয়, চায়নায় চায়নিজ, এই আপ্তবাক্য মেনে পুত্রের নুডুলস যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো, সেই গামলার সাথে আসা কারুকার্যখচিত জোড়াকাঠি নিয়েই।
ট্রে তে করে নিয়ে আসা ছোট ছোট বেশ ক’টা বাটিতে করে দেয়া নানান জাতের মশলা, সস এসব মিলিয়ে নিয়ে, অপুট হাতে কাঠি দিয়ে সেই সরস নুডুলস, মানে গামলা ভর্তি রসের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া দেড় দুই গজি লম্বা মোটা নুডুলস তুলতে গিয়ে দুই ভাইয়ের এক্কেবারে লাঠালাঠি, না বলা উচিৎ কাঠাকাঠি অবস্থা দেখে, হাসি চেপে নিজের চিকেন সাঁ’তের দিকেই মনোযোগ দিলাম। জানি মানা করেও লাভ নাই। অচিরেই যখন নিজেরাই বুঝে যাবে, কাঠি দিয়ে ঝোল আর নুডুলস খাওয়া বাঙালির কর্ম নয়। তখন নিজেরাই শরণ নেবে তারা চামচ কাঁটা চামচের।
‘মনু, পিকাসো কেমন লাগছে এ নুডুলস তোমাদের’। নুডুলসের বাটিতে কাঠকাঠিতে ব্যস্ত ভাতুষ্পুত্রদের ছবি তুলতে তুলতে হেলেন জানতে চাইতেই ‘ইয়াম্মি। তুমিও খাও এন। আমি তো এতো খেতে পারবো না’। আবেদন দীপ্রর।
‘না, না, তোমরাই খাও। যদি কিছু খাই, তবে আমি ঐ চিকেনই খাবো দাদার কাছ থেকে নিয়ে। আচ্ছা দাদা, নুডুলস যদি ওরা পুরোটা খেতে না পারে, তাহলে বাকিটা কি প্যাক করে দেবে না কি?’
কি যে বলিস না। নুডুলস আবার প্যাক করে দিবে কিভাবে? কিছুটা বিরক্ত হয়ে হেলেনের এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই
‘ওরা তো ‘টেক এওয়ে’ বিক্রি করে দেখেছি। আমরা যখন ছবি তুলতে গিয়েছি ঐ গেইটের কাছে, তখন তো দেখলাম একজন এসে ‘টেক এওয়ে’ নিয়ে গেল, প্লাস্টিকের বক্সে করে। তাহলে আমার যে টুকু বেঁচে যাবে, সে টুকু দেবে না কেন এরা প্যাক করে’। কাঠি কে ইস্তফা জানিয়ে একহাতে স্যুপ চামচ দিয়ে নুডুলসের রস তুলতে মুখে দিতে দিতে, অন্যহাতে কাঁটা চামচ গামলায় ডুবিয়ে সেটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নুডুলস পেঁচিয়ে মুখে দেবার জন্য তুলে আনতে আনতে দীপ্র বলতেই, দ্রুত হার মেনে বললাম, ঠিক আছে। ঠিক আছে তাহলে প্যাক করেই দিতে বলব।
‘আমারটা প্যাক করতে হবে না। পুরোটা খেতে পারবো’। এসময় অভ্রর এ ঘোষণা আসতেই, আঁতে ঘা লাগল তাতে বড় ভাইয়ের। সাথে সাথেই মুখ ভেংচিয়ে দীপ্র বলে উঠল
‘তুমি তো ছোট, তাই তোমার নুডুলসের বাটিটাও পিচ্চি’।
পাত্তাই দিল না অভ্র, ভাইয়ার মুখ ভেংচানোর। সামান্য একটু বড় ছোট হলেও খুব ছোট যে নয় তার গামলাটা তা তো দেখতেই পাচ্ছে স্পষ্ট সবাই। গলার জোরে তো আর কোনোটাকেই ছোট বা বড় করা যাবে না। এ ভাবনার রেশেই ফের মনে এলো সেই ব্যাপারটা, মানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর হত্যাকারীদের, হত্যাকারীদের সহযোগীদের ও রাজাকার আল বদরদের যে মিথ্যার গলাবাজি চলেছিল বহু দিন ধরে দেশে, তাতে প্রচুর জাজ্বল্যমান মিথ্যাকেও তো সত্যের মতো প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল ঐ মধ্যযুগীয় বর্বর ছুরি চাপাতি শানানো মিথ্যুকেরা। অতএব দীপ্রর ঐ মন্তব্যের ভিত্তিটা কি আসলেই জানা দরকার।
‘ওয়াক, থু’। বেশ শব্দ করে হেলেন এসময় আমার প্লেট থেকে টেনে নেয়া চিকেন সা’তে মুখ থেকে বের করতেই
‘খেতে পারবি না যখন, তখন নিলি কেন? এটা একটা রেস্টুরেন্ট, এখানে এভাবে বমির মতো আওয়াজ করলে অন্য যারা খাচ্ছে তাদেরও তো অরুচি এসে যাবে’। নিচুস্বরে করা তীব্র বিরক্তির আমার এই ভর্ৎসনায় –
‘সরি সরি। ভুল হয়েছে। আসলে ঐ যে সস টা দিয়েছে ওটাতেই মনে হচ্ছে কেমন যেন একটা গন্ধ আছে! ওটা না নিলেই হতো’। নিজেকে সামলে নিয়ে হেলেন বলে উঠতেই
‘এন আমাকে দাও, ঐ চিকেন টা। ওটা আমি খাবো’। খাবার নষ্ট করার ব্যাপারে বরাবরই তীব্র আপত্তি যার সেই দীপ্র, এইমাত্র ফুপ্পি কর্তৃক এক কাঠি চিকেন সা’তের এরকম অপচয় রোধে তার সংকল্প জানাতেই, দ্রুত সেটি ভাতুষ্পুত্রের হাতে তুলে দিতে দিতে, বলল-
‘মনু, পিকাসো, তোমরা তো দু রকম নুডুলস নিয়েছ। দু’জনেই দু’জনের টা ভাগাভাগি করে খাও তা হলে দুটাই তোমাদের টেস্ট করা হয়ে যাবে’।
‘হুম’ শব্দে দুজনেই ব্যাপারটিতে সম্মতি জানাতেই বোজা গেল অন্যসময়ে দু’জনের রেশারেশি বা প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকলেও এ ব্যাপারটা তাদের মনঃপুত হয়েছে।
নাও, নাও আমার কাছ থেকে চিকেনও নাও তোমরা, বলে দু’পুত্রের সামনের গামলা দুটোর পাশে থাকা সাইড প্লেটে দুটো চিকেন তুলে দিতেই, দীপ্র জানাল তার আর দরকার নেই। কারণ সে তো ফুপ্পির না খাওয়া ঐ চিকেনটা খাচ্ছেই।
‘আচ্ছা দাদা, আমরা কি এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ম্যাকে যাবো? কতো দূর ওটা এখান থেকে?’
‘না না, বাবা বলেছে খাওয়ার পর আমরা এখানটায় ঘুরে খুঁজে দেখবো অ্যাপেল স্টোর আছে কি না। তাই না বাবা ম ম ম ম।‘ ফুপ্পির কথার জবাবে এ কথা ক’টি বলতে বলতে, কাঁটা চামচে জড়ানো দেড় দু’গজি লম্বা মোটা নুডুলস মুখস্থ করতে গিয়ে দীপ্রর বাকি কথা জড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো খুক খুক কাশি। ব্যাপারটা সামলানোর জন্য পাশে বসা হেলেন ওর দ্রুত পিঠ চাপড়ে দিতে শুরু করতেই, বেশ অস্থিরতা নিয়ে আশঙ্কিত আমি বললাম –
ঠিক আছে, তাই হবে। আগে খাওয়া শেষ হউক। কথা বলতে বলতে এই ঝোলঅলা নুডুলস খেতে গিয়ে গলায় আটকে যাবে খাবার। না, আর নয় কোনো কথা।
কপাল ভাল দ্রুতই সামলাতে পারল দীপ্র তার কাশি। তাতে টেবিলে স্বস্তি ফিরে আসতেই, কাঁটা চামচ, টেবিল চামচের টুং টাং, আর দু ভাইয়ের দেড় দু’গজি লম্বা নুডুলস মুখের ভেতরে টানার সুড়ুত সুড়ুত শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দের অবতারণা না করে, হেলেন ছাড়া বাকি সবাই গভীর মনোনিবেশ করলাম যার যার খাবারে।
বেশি সময় লাগলো না, চিকেন সা’তে সাবড়ে দিতে আমার। নাহ, ভালই লেগেছে। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায় খাওয়া চিকেন সা’তের সাথে খুব একটা তফাৎ নেই। শুধু সা’তের সাথে দেওয়া বাদামের সসটা একটু অন্যরকম লেগেছ। এদিকে নিঃশব্দ এই খাবার পর্যায়ের এক পর্যায়ে দেখি ফুপ্পির কথানুযায়ী দু’ভাই অদলবদল করে নিয়েছে নিজেদের নুডুলসের গামলাও। অতপর একসময় দু’ভাইয়ের খাওয়া শেষ হতেই, অভ্রর গামলাটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে দীপ্র বলল,
‘বাবা, এখানে খুব বেশি নেই। আমি আর খেতে পারবো না। তুমি বাকিটা খেয়ে নাও। আর অভ্র যদি খেতে পারে আমারটা তবে ও খেয়ে নিক’।
‘না না আমিও আর খাবো না। পেট ভরে গেছে। এখানে অনেক আছে এখনো‘ দ্রুত একথা অভ্র জানাতেই, দীপ্র ফের খাবার প্যাক করার দাবী তুলতেই বললাম, ঠিক আছে ডাকছি ওয়েটারকে। সাথে সাথেই এতোক্ষণ মনে ঘাই মারতে থাকা প্রশ্নটা টুপ করে ছুড়ে দিলাম-
আচ্ছা বাবা, বঙ্গবন্ধুকে তোমার কী মনে হয়?
‘কী মনে হয় মানে? উনি তো আমাদের ফাদার অব দি নেশান। ওনার জন্যই তো আমরা পাকিস্তানি শয়তানদের হারাতে পেরেছি। হি ইজ আওয়ার গ্রেটেস্ট লিডার’। এতোটুকু বলে দীপ্র তার মতামত আরো বিস্তারিত করতে যাবে যখন তখনই পাশ থেকে অভ্র বলে উঠলো – ‘এক্সচুয়ালি হি ইজ বাংলাদেশ’!
লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআছি আজাদীর সাথে থাকবো চিরকাল
পরবর্তী নিবন্ধস্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা ও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট