স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা ও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন এমন একজন মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর মহান চিন্তাধারা, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও স্বদেশ প্রেম প্রত্যেক মানুষের মনে এক গভীর রেখাপাত করে। তাঁর অভূতপূর্ব দূরদর্শী মনোভাব মাতৃভূমির বিকাশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেই সময়কার দিনগুলোতে। নোবেল বিজয়ী ফরাসী উপন্যাসিক রোম্যা রোঁলা বলেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের বাণীগুলো কেউ শুয়ে পড়লে, তিনি উঠে বসেন। বসে পড়লে দাঁড়িয়ে যান। এবং দাঁড়িয়ে পড়লে দৌড়াতে থাকেন। এমন প্রেরণাদায়ী ছিল বাণীগুলো। মানুষের আত্মবিশ্বাস জাগানোর জন্য স্বামীজীর বাণীগুলো অত্যন্ত প্রেরণাদায়ী। প্রচলিত আছে, যে ঈশ্বর বিশ্বাস করেনা সে নাস্তিক কিন্তু স্বামীজী বলেন, যে নিজেকে বিশ্বাস করেনা সেই বড় নাস্তিক। অনেক সাহসী উচ্চারণ ছিল তা। আবার জীবনধারা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল মন আামাদের নিয়ত নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নিয়ে যাবে এবং চরমে আমাদের বিধ্বস্ত করবে, ধ্বংস করবে। আর সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত মন আমাদের রক্ষা করবে, মুক্তিদান করবে।’ যুবকদের প্রতি এটি ছিল তাঁর চরম সাবধান বাণী।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রদত্ত শিকাগো বক্তৃতা ইতিহাসে কয়েকটি বক্তৃতার অন্যতম। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ দিনটি ছিল সোমবার। আমেরিকার শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট হলের বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলনের আসরে বক্তা তালিকায় রয়েছেন খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদি, ব্রাহ্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিল্টো, জরথ্রুষ্ট, তাও এবং কনফুসিয়াস ধর্মের সবমিলিয়ে দশটি ধর্মের প্রতিনিধি রয়েছে। আর এই কারণেই ঠিক বেলা ১০টায় দশবার ঘন্টা বাজিয়ে শুভ উদ্ধোধন মুহূর্ত ঘোষিত হল। ঘোষণা মুহূর্তে মঞ্চে ছিলেন দশ ধর্মেরই দশজন বক্তা। তাঁদেরই একজন বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। পরণে ছিল লালচে রঙের পোশাক ও মাথায় গেরুয়া পাগড়ি। অন্য নয়জন বক্তার থেকে পোশাক, রঙ্গ এবং চোখেমুখে ছিল তাঁর আলাদা এক দীপ্তি। আর সেই কারণেই কলম্বাস হলে থাকা হাজার পাঁচেক শ্রোতার নজর আলাদা করে বারে বারেই পড়ছিল তখনকার ভারতবর্ষ থেকে যাওয়া এই তেজদীপ্ত যুবক সন্ন্যাসীর দিকে।
স্বামী বিবেকানন্দের সে ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। শিকাগোর বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘খ্রিস্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না, কিন্তু প্রতিটি ধর্মই অন্যান্য ধর্মের সারভাগ গ্রহণ করে পুষ্টি লাভ করবে এবং স্বীয় বিশেষত্ব বজায় রেখে নিজ প্রকৃতি অনুসারে বর্ধিত হবে।’ কি অপুর্ব আহবান সর্বধর্ম সমন্বয় তথা জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠায়! তিনি আরও কঠোর ছিলেন কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। স্বামীজীর মতে, দর্শনবর্জিত ধর্ম কুসংস্কারে গিয়ে দাঁড়ায়, আবার ধর্মবর্জিত দর্শন শুধু নাস্তিকতায় পরিণত হয়। ধর্ম মহাসম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘সামপ্রদায়িকতা ও গোড়ামী গুলোর ভয়াবহ ফলস্বরূপ, ধর্মোম্মোত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করে রেখেছে; পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করেছে। বারবার এটিকে নরশোনিতে সিক্ত করেছে। সভ্যতা ধবংস করেছে এবং জাতিসমূহকে হতাশায় মগ্ন করেছে। এ ভীষণ পিচাশগুলো যদি না থাকত, তা হলে মানব সমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হত। তবে এর মৃত্যুকাল উপস্থিত এবং আমি সর্বোতভাবে আশা করি, এ ধর্ম মহাসমিতির সম্মানার্থে, আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হয়েছে, তাই সর্ববিধ ধর্মোম্মত্ততা, তরবারী অথবা লেখনি মুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক’। শিকাগো সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের উদ্বোধনী ভাষনে উপরোক্ত আশাবাদ ব্যক্তের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিদ্যমান ছিল। আর তাহলো উগ্রজাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ ও সম্রাজ্যবাদ মিলিয়ে এমনভাবে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছিল, সে সময়ের ইউরোপসহ সারাবিশ্বের মানবতাবাদ বিকাশের জন্য ব্যাপক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার প্রেক্ষিতেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর উক্ত বক্তৃতায় সমস্ত কিছুর অবসানের বার্তা দিয়েছিলেন তাঁর ভাষণে।
শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্য ও আদর্শ প্রসঙ্গে শেষ অধিবেশনে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি এখানে কেহ এরূপ আশা করেন যে, বিভিন্ন ধর্মসমূহের মধ্যে একটির অভ্যুদয় ঘটবে এবং তা অপরগুলির বিনাশ দ্বারা সাধিত হইবে, তবে তাহাকে আমি বলি, ভ্রাতঃ তোমার আশা ফলবতী হওয়া অসম্ভব। আমি ইচ্ছা করি না যে, খৃষ্টান হিন্দু হউন অথবা হিন্দু বা বৌদ্ধ খৃষ্টান/মুসলিম হউন। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই অন্যান্য ধর্মগুলোর সারভাগ গুলিকে ভিতরে গ্রহণ দ্বারা পুষ্টি লাভ করিয়া আপনার বিশেষত্ব রক্ষাপূর্বক নিজের প্রকৃতি অনুসারে পরিবর্ধিত হই। সে্বামীজীর মতে পবিত্রতা, উদারতা, চিত্তশুদ্ধি প্রভৃতি সদগুণ সমূহ কোনো ধর্মেরই নিজস্ব নহে এবং প্রত্যেক ধর্মেই উন্নত চরিত্র নরনারীর অবির্ভাব হইয়াছে। শীঘ্রই দেখিবেন সকল ধর্মের পতাকাশীর্ষে লিখিতে হইবে, ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি’। স্বামীজীর এই বাণী পুরো বিশ্বের প্রতি শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
সম্মেলনে ১৫ সেপ্টেম্বর ভ্রাতৃভাব নিয়ে দেওয়া বক্তৃতার উপর শিকাগো সানডে হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণী থকে জানা যায়, স্বামীজীর মতে মানুষের ভ্রাতৃত্বই বহু-আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য। এই ভ্রাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক অবস্থা, কারণ আমরা সকলে একই ঈশ্বরের সন্তান। অতএব সার্ব্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য সমগ্র মানবজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করিবার জন্য আমাদের মিলনভূমি প্রশস্ত করা প্রয়োজন। মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা আমাদের কর্তব্য। ঈশ্বরের সর্বজনীন পিতৃত্বে আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, ভাইকে আমাদের ভালোবাসতেই হবে, কারণ প্রত্যেক ধর্ম ও প্রত্যেক মত মানুষের দিব্যভাব স্বীকার করে। উক্ত অধিবেশনে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণ স্ব স্ব ধর্মের প্রাধান্য-প্রতিপাদনের জন্য বাগ-বিতণ্ডায় নিযুক্ত হয়েছিলেন দেখে স্বামীজী কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন। তাঁর মতে আমার ধর্মই সেরা, এরূপ সংকীর্ণ ভাবই আমাদের মতভেদের কারণ।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালেও আমরা দেখি, ধর্ম নিয়ে আজও পৃথিবী সন্ত্রস্ত। মৌলবাদীদের আস্ফালন সর্বত্র, মানুষের জীবন বিপন্ন। ধর্মের নামে শক্তি প্রয়োগ ও সংঘাতের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমষ্টির উপর আঘাত এনে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে বা ভীতির আবহ তৈরি করে সাধারণ জনগণের মনে ভীতি সৃষ্টি করা সন্ত্রাসের প্রাথমিক লক্ষ্য। আমরা আরও দেখি ভিন্নমত, সংস্কৃতি ও দর্শনে বিশ্বাসী তথা ভিন্ন জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর উগ্র আঘাত হেনে সরকার ও জনগণের উপরে চাপ সৃষ্টি করে ফায়দা লাভের প্রচেষ্টা। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসহ ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত অসহিষ্ণুতার প্রভাব থাকে সুগভীরভাবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির নিজস্ব ঘৃণা ও ঘৃণ্য কৌশলকে সমষ্টির আবেগে মুড়িয়ে সন্ত্রাসী উন্মাদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বহু উদাহরণ রয়েছে। দেশে দেশে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো মালা গেঁথে নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে সেতুবন্ধন স্থাপনের চেষ্টা এমন কৌশলের উদাহরণ যেটা এখন বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটছে। বিবেকানন্দ মন ও মুখের সত্যতায় স্পষ্টত জানান ‘ধর্ম মানুষের বন্ধু, তা কোনও শর্তাধীন নয়। বিনিময়যোগ্য স্বার্থের আদানপ্রদানে সঙ্কুচিতও নয়। ধর্ম বিবর্তনের পথেই এগোয়। ধর্ম সমাজের দায় বহন করে। নিরন্ন মানুষের জন্য অন্ন, অসুস্থ পীড়িতের জন্য ত্রাণ-সেবা, অনাথ-বিধবার অশ্রুমোচনের দায়িত্ব ধর্মকেই নিতে হয়’। সেই সময়ের উচ্চারিত চরম সত্য আজকের বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ও মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় না মেনে উপায় নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমমতাজ সুলতানা