দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জানালার বাইরে চোখ দিয়ে বসে আছি। ছুটছে ট্রেন, দুরন্ত গতি। বাইরের সবুজ গাছ, ফুলেল বাগান, মাঠের গরু সবই ছুটছে, তীব্র গতি। সবই দৌঁড়াচ্ছে পেছনে। সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি আমি। ট্রেনের ভিতর থেকে আমরা যে ছুটছি সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। বুঝা যাচ্ছিল না ট্রেনের গতিও। তবে বগির দরোজার উপরে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ট্রেনটির গতি প্রদর্শিত হচ্ছিল। গাড়ির স্পিডমিটারের মতো এখানেও গতি বাড়ছে, ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সংখ্যা, কেবলই বাড়ছে। ২০০—-২১০—২৩০—২৫০—২৮০—২৯০—২৯৫—- কিলোমিটার বেগে ছুটছে আমাদের ট্রেন। ২৯৫ কিলোমিটার বেগে ট্রেন! আমি কী হার্টবিট মিস করতে শুরু করেছি? কিন্তু ট্রেনের ভিতরে কোন পরিবর্তন নেই। কিচ্ছুটি বুঝা যাচ্ছে না। ড্রয়িং রুমের সোফার মতো সিটে বসে আছি। পানির যে বোতলটি নিয়ে ট্রেনে চড়েছিলাম সেটি সামনের সিট কাভারের পেছনে একটি খোপে রেখেছি। কিন্তু বোতলের পানি একটুও কাঁপছে না। এত বেগে ছুটছি, অথচ কোন নড়চড় নেই! চীনা ইঞ্জিনিয়ারেরা কী বানিয়েছে রে বাবা!

২৯৫ কিলোমিটারের গতি নিয়ে যখন এসব ভাবছি তখন স্পিডমিটারে প্রদর্শিত সংখ্যা ৩০০। ট্রেনটির গতিবেগ ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটার! ও মাই গড! করছে কি? ৩০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন! আগেই বলেছি আমাদের হেলিকপ্টার চলে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে। আমাদের বিমানগুলো চলে গড়ে সর্বোচ্চ ৫শ’ কিলোমিটার বেগে। আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এয়ারবাস কিংবা বোয়িংগুলো চলে ঘন্টায় গড়ে ৮শ’ কিলোমিটার বেগে! আমাদের ট্রেনের গতি সীমাবদ্ধ থাকে ৩০ থেকে ৬০ কিলোমিটারে! অথচ চীনারা ৩০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালাচ্ছে! আর সেই ট্রেনে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি! শরীর মনে কেমন যেন এক রোমাঞ্চ খেলা করে গেল!! অন্যরকমের এক শিহরণ অন্তরজুড়ে!

ঘন্টায় ২৯৪ কিলোমিটার বেগের ট্রেনে চড়েছিলাম বছর কয়েক আগে। ওই যাত্রার আনন্দে বহুদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজ ছিল আমার। ট্রেন দেখলেই মনে পড়তো ওই যাত্রার কথা, ২৯৪ কিলোমিটারের বেগের কথা। লন্ডন থেকে ট্রেনে চড়ে প্যারিস যাওয়ার সময় আমাদের ট্রেনের গতিবেগ ২৯৪ কিলোমিটার দেখে ভিমরি খাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ইংলিশ চ্যানেলের তলদেশে টানেলের ভিতর দিয়ে ছুটছিল আমাদের ট্রেন। জীবনভর ৩০ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগের ট্রেনে চড়া এই আমি যখন ঝড়ের চেয়ে বেশী বেগের ট্রেনে চড়ে প্যারিস হাজির হয়েছিলাম তখন নিজের অবস্থা হয়েছিল একেবারে অন্যরকম।

নিজেকে মনে হয়েছিল ভিনগ্রহের বাসিন্দা। আরো মজার ব্যাপার ছিল- ইউরোস্টারের ওই ট্রেনটি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উর্বশী টাইপের এক নারী, বিদেশীনি। ট্রেনটি প্যারিসের লাস্ট স্টেশন গার দো নর্ড এ থামানোর পর বিমানবাহিনীর অফিসারের মতো পোশাক পরিহিত ওই নারী চালক ইঞ্জিনরুম থেকে নেমে এসেছিলেন নিচে। ট্রেনের বডির সাথে হেলান দিয়ে রাজহংসীর মতো এমন মোহনীয় ভঙ্গিমায় সহকারীর সাথে গল্প করছিলেন যে আমার নজর আটকে গিয়েছিল। খুব ইচ্ছে করছিল কী করে তিনি এমন বেগে ছুটেছিলেন তা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু প্রশ্নটি করা হয় নি, তবে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলতো করে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম তাকে। নিরাপদে প্যারিসে পৌঁছে দেবার জন্য জানিয়েছিলাম কৃতজ্ঞতা।

তবে সত্যি কথা বলতে কী, লন্ডন থেকে প্যারিস পর্যন্ত ঝড়োগতির ওই ট্রেনটির ব্রিটিশ তরুণী চালক আমাকে যতটুকু না মুগ্ধ করেছিলেন তার থেকে ঢের বেশী আচ্ছন্ন করেছিল ট্রেনের গতি। ঘন্টায় প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেনে চড়ে আমার মেজাজের ফুরফুরে ভাব তখন তুঙ্গে। এর আগে টোকিওতে শুধু গতি দেখার জন্য একবার বুলেট ট্রেনে চড়ার গল্প ইতোমধ্যে আপনাদের বলেছি। গতি দেখার জন্য টোকিও থেকে জাস্ট পরের স্টেশনে নেমে ফিরতি ট্রেন ধরে আবার টোকিও পৌঁছেছিলাম। দুইশ’ কিলোমিটারের কাছাকাছি বেগে জাপানের ওই ট্রেনটি সাপের মতো ছুটেছিল। ফলে লন্ডন-প্যারিস রুটের যাত্রাই মাটিতে আমার জীবনের সর্বোচ্চ গতি বলে ধরে নিয়েছিলাম। কারণ এর থেকে বেশি বেগে কোনদিন ছুটতে পারার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতাম না। মাটিতে ২৯৪ কিলোমিটার!

এনাফ ইজ এনাফ, এর থেকে বেশি ছুটতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে! ওই মাই গড! আমি যখন প্যারিস সফরে নষ্টালজিক তখন চীনের বেইজিংমুখী ট্রেনটির গতিবেগ ঘন্টায় ৩০৮ কিলোমিটার! ৩০৮ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলে! সত্যি, এটি এই ট্রেনের গতিবেগ! মাত্র আট ঘন্টায় এই ট্রেন পাড়ি দেবে দুই হাজার চারশ’ কিলোমিটার! আয়েশে শরীর নুয়ে আসছিল। কি যে আরাম! কোন শব্দ নেই, কোন উৎপাত নেই, নেই কোন ‘ঠক্কর মক্কর’। এমন আয়েশী আবহে কফিতে চুমুক দিতে পারলে তৃপ্তির ষোলকলা পূর্ণ হতো! আমার পাশের সিটসহ আশেপাশের সবগুলো সিটেই চীনা নাগরিক। অবশ্য চীনা নাকি ধারে কাছের অন্য কোন দেশের নাগরিক সেটা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের লোকজনও হতে পারে। কারণ নিউইয়র্ক সিটিকে বিশ্বের রাজধানী বলা হলেও চীনকে বলা হয় বিশ্বের মেগাকারখানা। এখানে সব অঞ্চলের সব দেশের মানুষ কিলবিল করে।

তাছাড়া চীনা এবং ধারেকাছের দেশগুলোর মানুষগুলোর চেহারাও প্রায় একই ধাঁচের। গায়ের রং ফর্সা এবং নাক চ্যাপ্টা হওয়ার কারণে বুঝার সাধ্যি নেই যে কে চীনা কিংবা কে কোরিয়ান! আবার থাইল্যান্ড কিংবা বার্মারও হতে পারে! পাশের সিটে বসা ভদ্রলোকের সাথে শুধু একবার ‘হ্যালো’ বিনিময় হয়েছিল। উনি আগ্রহ না দেখানোতে আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারিনি। এক ঘন্টারও বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও আর একটি কথাও হয়নি। কায়সার ভাই আমাকে বলে দিয়েছেন যে, ট্রেনে সব ধরনের খাবার দাবার পাওয়া যায়। ভাত-রুটির পাশাপাশি চা কফি কোল্ড ড্রিংকস থেকে শুরু করে বিয়ার টিয়ার পর্যন্ত। অবশ্য এক ঘন্টা অতিক্রান্ত হলেও খাবার দাবার কিংবা চা কফি বিক্রি করতে কাউকে হাকডাক করতে দেখিনি। ধারে কাছের অনেকেই নিজেদের ব্যাগ থেকে বের করে বিস্কিট, চিফস এবং কুমড়ো বিচি টাইপের জিনিসপত্র খাচ্ছেন। আমার অবশ্য অন্য কিছু খাওয়ার তেমন কোন ইচ্ছে নেই, ক্ষুধাও নেই। শুধু একটু চা কিংবা কফি পেলে জার্ণিটা মনের মতো হয়ে উঠতো।

হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নানা কিছু ভাবছিলাম। কোথায় থেকে কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি! বেইজিং গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক মতো ম্যানেজ করতে পারবো কিনা! কোন প্রতারকের পাল্লায় পড়বো কিনা, ভাষার সংকট এত প্রকট যে মনে মনে সাহস রাখার চেষ্টা করেও সাহস হারাচ্ছিলাম! ‘টুং টাং’ টাইপের একটি শব্দ কানে লাগলো। চোখ খুললাম!

ও মা! এতো দেখি বিমানের মতো ট্রলি ঠেলে ঠেলে খাবার দাবারসহ নানা কিছু বিক্রি করা হচ্ছে। আমার অন্তর নেচে উঠলো। চা কফি হাজির হয়ে গেছে। চীনা রেলওয়ের ইউনিফর্ম পরিহিত সুন্দরী এক তরুণী ট্রলি ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে এগুচ্ছেন। বুঝতে পারলাম যে, বাইরের কোন হকারের এখানে হাঁকডাক করার সুযোগ নেই। যা করার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষই করবে। খেয়াল করে দেখলাম যে তরুণী নগদ টাকায় খাবার বিক্রি করছেন। ক্রেডিট কার্ডের কোন ঝামেলা নেই। ডলার ইউরোরও কোন কারবার নেই। স্রেফ চীনা ইউয়ান দিন, যা ইচ্ছে কিনে নিন। ফেলো কড়ি মাখো তেলের মতো ব্যাপার স্যাপার। আমার খুব মনে পড়লো, লস-এঞ্জেলস থেকে বোস্টনের প্রায় ছয় ঘন্টার ফ্লাইটের কথা। দীর্ঘ ওই ফ্লাইটে কফি তো দূরের কথা ক্রেডিট কার্ড না থাকলে এক বোতল পানিও পাওয়া যায় না।

আমেরিকান মুদ্রা ডলার নগদে দিয়েও ফ্লাইটে কোন কিছুই কেনার সুযোগ রাখা হয়নি। যাত্রীদের মধ্যে যাদের ক্রেডিট কার্ড নেই তাদের ভোগান্তি নজিরবিহীন। শুধু আমেরিকাই নয়, ইউরোপেও বাজেট এয়ারগুলোতে যাত্রীরা ক্রেডিট কার্ডের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। কেউ কেউ পাশের সিটের যাত্রীকে নগদ ডলার দিয়ে ওনার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে চা কফি কিংবা খাবার কিনে খান। ছয় সাত ঘন্টার ফ্লাইটে চা পানি না খেয়ে কি শুকনো মুখে বসে থাকা যায়! চীনের গুয়াংজু বেইজিং হাইস্পিডের ননস্টপ ট্রেনে এমন জিম্মিদশা না থাকায় হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। চীনা তরুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি এক মগ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজসেবায় সম্মাননা পেল মমতা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ