প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

| বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মসজিদুল হারাম : সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে

মসজিদুল হারাম, যে মসজিদ পবিত্র কাবাকে চতুর্দিক দিয়ে বুকে ধারণ করে আছে। বিশ্বের বুকে সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মসজিদ। এই মসজিদুল হারাম আগে অনেকটা ছোট কলবরে ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীন, ওমাইয়া, আব্বাসী আমলে মসজিদুল হারমের কম বেশি কাজ হয়। ৪/৫ শত বছর তুর্কিদের শাসনামলে মসজিদুল হারাম বৃহত্তর পরিসরে নির্মিত হয়েছে। ১৯৫০ এর দশকে বাদশাহ আবদুল আজিজ মাতাফ সংলগ্ন তুর্কি হেরেমের সম্মুখভাগ ঠিক রেখে বৃহদাকারে মজবুত করে মসজিদুল হারম পুনঃ নির্মাণ করেন। অর্থাৎ সম্মুখ দিকে মাতাফ সংলগ্ন ছোট কলবরে একতলা বিশিষ্ট হারমের পেছন সংলগ্ন ৩ তলা বিশিষ্ট বিশালাকারের মসজিদুল হারাম বাদশাহ আবদুল আজিজ নির্মিত। এতে সাফা-মারওয়া অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। বাদশাহ আবদুল আজিজ ইন্তেকালের পর সউদের আমলে এ তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদুল হারামের কাজ সমাপ্ত হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৫ সালে বাদশাহ ফয়সল ইন্তেকাল হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও মুসলিম বিশ্বের কল্যাণে তিনি কাজ করে গেলেও মসজিদে নববীর পাশাপাশি মসজিদুল হারামের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান পরিলক্ষিত হয়নি।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাদশাহ খালেদের আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানান পরিকল্পনা নিয়ে সৌদি আরব এগিয়ে যায়। কিন্তু মসজিদে নববীর পাশাপাশি মসজিদুল হারমে উল্লেখযোগ্য অবদান তার আমলেও দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে তার আমলে ১৯৭৯ সালে হজ্বের ২ সপ্তাহ পর কয়েক শত জনের ইসলামিক গ্রুপ ফজরের জামাতের পরপর মসজিদুল হারাম অবরোধ করে। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতের পর ইসলামিক গ্রুপের অনেকে মারা যায়, বাকীরা ধরা পড়ে।

অতঃপর মসজিদুল হারামের ও মসজিদে নববীর গেইটে গেইটে পাহারা ও তল্লাশির ব্যবস্থা করা হয়। যা আজও চলমান। তার আগে মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে নিচতলায় গরীব দেশের হাজীরা অবস্থান নিত। এখনকার মত তেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল না। ১৯৮২ সালে বাদশাহ খালেদের ইন্তেকালে বাদশাহ ফাহাদ ক্ষমতায় আসেন। তিনি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে মসজিদে নববীকে আগের চেয়ে ৮/১০ গুণ বড় করে সম্প্রসারণ করেন অত্যধিক ব্যয়ে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমেত আরামের যাবতীয় কিছু সংযোজন করে। একই সাথে পবিত্র মদিনা শহরকে সাজিয়ে দিয়ে যান।

কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে তিনি মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণে পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। বাস্তবতা থেকে তা বুঝে আসা যায়। তিনি মসজিদে নববীর মত মসজিদুল হারাম সম্প্রাসরণে নক্‌শাসহ যাবতীয় কিছু কাগজে পত্রে করে গেলে কতই না উত্তম হত। মনে হয় তা করা হয়নি।

বাদশাহ ফাহাদ ১৯৮৫ সালে মসজিদে নববী বিশাল আকারে সম্প্রসারণ শুরু করে ৩ বছরের ব্যবধানে মসজিদুল হারামের পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণ করেন আগের অবকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এই সম্প্রসারিত অংশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়। মাতাফের উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করেন। বাদশাহ ফাহাদ মসজিদুল হারামের যে ভূমিকা পালন করে গেছেন তৎমধ্যে তাওয়াফের স্থান মাতাফে পাথর পরিবর্তনে মিশরের স্থপতি মুহাম্মদ কামাল ইসমাইলের ভূমিকা স্মরণীয়। আগে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা কম ছিল বিধায় মাতাফ ভিতরের দিকে অর্ধাংশ ছিল। বর্তমান বর্ধিত অংশের বাকী অর্ধেক অব্যবহৃত ছিল।

কবুতর বসত হাজীরা কবুতরের খাদ্য গম ছিটাত। বিশ্বখ্যাত মিশরীয় স্থপতি চিন্তায় পড়ে যান মাতাফে মার্বেল পাথর সূর্যের তাপে যাতে গরম না হয়। মহান আল্লাহ পাকের মহিমা স্থপতি খবর পেয়ে যান গ্রিসে একটি ছোট পাহাড় রয়েছে। ঐ পাথরের পাহাড় গরমকালেও গরম হয় না। তাপ শোষণ করে নেয়। এতে স্থপতি কামাল গ্রিসে চলে যান। পাহাড়ের মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন পাহাড়ের অর্ধেক পাথর পেতে। চুক্তি স্বাক্ষর করে পবিত্র মক্কায় ফিরে আসেন। পাহাড়ের অর্ধেক পাথরও পবিত্র মক্কায় চলে আসে। বর্তমানকালে কবুতরের বিচরণের এরিয়াসহ পুরো মাতাফে এ পাথর বসানো হয়। বিষয়টি বাদশাহ ফাহাদের নজরে আসে। এতে তিনি মসজিদে নববীর চত্বরে এ পাথর বসাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারামে টুকরা টুকরা উন্নয়নে অবদান রেখেছেন মাত্র। কিন্তু পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববী বিশালাকারে আধুনিকতার সমন্বয়ে সম্প্রসারণে অতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এতে স্থপতি মুহাম্মদ কামাল ইসমাইল খুব বিব্রত অবস্থায় পড়েন। এই ধরনের পাথর পাওয়ার জন্য বিশ্বে একটি জায়গা, সেটি গ্রিসে। তখন স্থপতি পুনরায় গ্রিসে গমন করেন। এতে পাহাড়ের মালিক বা কর্তৃপক্ষ জানান আপনি চলে যাওয়ার পরপরই পাহাড়ের বাকী অর্ধেক মার্বেল বিক্রি হয়ে গেছে। পবিত্র মাতাফে ব্যবহারের ১৫ বছর পর ক্রয়কৃত পাথর ক্রেতা অব্যবহৃত রেখে দিবে তা আশা করা যায় না। এতে স্থপতি হতাশ হয়ে পড়েন। স্থপতির অনুরোধে গ্রিসের পাহাড়ের মালিক বা মালিক পক্ষের লোক ফাইল ঘেটে জানান সৌদি আরবের এক কোম্পানী এ অবশিষ্ট পাথর ক্রয় করে নিয়ে গেছেন।

তখন স্থপতি গ্রিস থেকে নেয়া ঠিকানা মতে সৌদি কোম্পানীর সাথে সাক্ষাত করেন। সৌদি কোম্পানীর মালিক জানান এ পাথর এখনও গুদামে রয়ে গেছে, ব্যবহৃত হয়নি।

এত দামী পাথর এত বছর অব্যবহৃত আছে জেনে দেখে স্থপতি কোম্পানীর মালিকের সামনে শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। কেঁদে কেঁদে কোম্পানীর মালিককে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। কোম্পানীর মালিককে একটি ব্ল্যাংক চেক দিলেন এবং স্থপতি বললেন আপনার যত টাকা লাগে লিখে নিতে পারেন। এতে কোম্পানীর মালিক জানতে পারলেন এ মার্বেল দুই পবিত্র হারামের জন্য চাচ্ছেন। তখন কোম্পানীর মালিক বললেন, আমি এক রিয়ালও গ্রহণ করব না। আল্লাহ আমার দ্বারা এ অবশিষ্ট পাথর ক্রয় করিয়েছেন যাতে আমার নিকট সংরক্ষিত থাকে। আমি যাতে আপনার মাধ্যমে দুই পবিত্র হারামে এ সাদা মার্বেল পাথর ব্যবহার করার জন্য দিতে পারি সে লক্ষ্যে আল্লাহ আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।

স্থপতি সৌদি বাদশাহ ফাহাদ ও বিন লাদেন কোম্পানীর পক্ষে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। মিশরের আরবীয় এ স্থপতি লাদেন কোম্পানীর বাকার বিন লাদেনকে বলেছিলেন দুই পবিত্র মসজিদে আমার কাজের জন্য টাকা গ্রহণ করলে বিচারের দিন কিভাবে আল্লাহর মুখোমুখি হব। এই স্থপতি ১৯০৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের ২ আগস্ট ৯৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

স্থপতির উক্ত বর্ণনা দৈনিক আজাদীতে ইতিপূর্বে প্রকাশ করা হয়েছিল। অদ্য পাঠক মহলে আংশিক তুলে ধরা হল।

মসজিদুল হারামে মসজিদে নববীর মত হাত বাড়ালেই জমজমের পানি পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা করা হয় কয়েক দিকে স্ক্যালেটার। যাতে ২য় তলা ও ছাদে নামাজীরা উঠতে পারে, নামাজ ও তাওয়াফ করতে পারে।

শেষের দিকে এসে বাদশাহ ফাহাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বাদশাহ আবদুল্লাহ যুবরাজ থেকেও ভারপ্রাপ্ত হিসেবে অনেক দিন কাজ চালিয়ে যায়। ২০০৫ সালে বাদশাহ ফাহাদ ইন্তেকাল করলে আবদুল্লাহ পূর্ণাঙ্গ বাদশাহ হন। তার আমলে মসজিদুল হারাম সম্পর্কিত বড় উন্নয়ন কাজ হয় দু’টি। আমার কাছে এ দু’টি কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

তার কাজ দেখে মনে হচ্ছে তিনিও মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। করে থাকলেও মনে হয় বাস্তবতার সাথে মিল খাচ্ছে না। তিনি মসজিদুল হারম পশ্চিম-উত্তর দিকে বিশালভাবে সম্প্রসারণ করেন। যা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরীণ ভাগ আগেকার অবকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য নয়।

তিনি পিতা বাদশাহ আবুদল আজিজ নির্মিত ৩ তলা বিশিষ্ট বিশাল মসজিদুল হারাম ৩ বছরে ৩ অংশে করে ভেঙে পুনঃ নির্মাণ করেন। আগেকার অবকাঠামো হয়ত প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ছিল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তিনি মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে আংশিক কাজ করলেও উত্তম হত। মনে হচ্ছে তা হল না। অর্থাৎ তার আমলে মসজিদুল হারাম উত্তর-পশ্চিম দিকে বিশালভাবে সম্প্রসারণ, পিতার আমলে মসজিদুল হারাম পুনঃ নির্মাণ এই দু’টি বড় বড় কাজ জানি না মসজিদুল হারাম বিশালভাবে সম্প্রসারণ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কি না! (আগামীবারে সমাপ্ত)।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধনিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করা মানব ধর্ম