দূরের দুরবিনে

আবহাওয়া ও মন মগজের হিট স্ট্রোক

অজর দাশগুপ্ত | রবিবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ at ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ

দেশে এখন প্রচণ্ড গরম পড়ছে। এই গরম যে কত প্রকার ও কি কি তা আমাদের ভালো জানা আছে। একেক বছর সিডনিতে এমন তাপমাত্রা বাড়ে যা অসহনীয়। দেশের সাথে তফাৎ আরো একটা আছে। আমাদের দেশে প্রকৃতি নিধন স্বাভাবিক ব্যাপার। নেতা থেকে কর্মী সবাই গাছ কেটে উজাড় করতে পারলেই টু পাইস কামানোর ধান্দায় দেশের বন বাদাড় উজাড় করার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বলছিলাম আমাদের এই সিডনিতে গরমের সময় বুশ ফায়ার হয়। আপনারা যারা জানেন তাদের এও জানা আছে এই বুশ ফায়ার বা আগুনে বন পোড়া কতটা মারাত্মক হতে পারে। এদেশে ঘন সবুজ যেমন আশীর্বাদ রাস্তাঘাট শহর নগর গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু এই বিষফোঁড়া বুশ ফায়ার ও ভয়ংকর। যার নাম দাবানল। এই দাবানল যে কতটা ভয়াবহ তা না দেখলে বোঝানো যাবে না।

যে ডিসেম্বরে কোভিড হানা দিলো ২০১৯ এর সে ডিসেম্বরে আমি একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি চারদিকে কালো ধোঁয়া। সাথে বাতাসে ভারী শিশার গন্ধ। ভেবেছিলাম অল্প পথ হেঁটে গিয়ে বাসে চাপলেই হবে । না পারি নি। কয়েক কদম পা বাড়াতেই মনে হলো গলায় যেন কাঠ কয়লার টুকরা ঢুকে গেছে। দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা। এমন কি নি:শ্বাস নিতেও বেগ পেতে হচ্ছিল। এ দেশে যেখানে সেখানে ওয়াক থু করে থুথু ও ফেলা যায় না। একপ্রান্তে সরে গিয়ে জায়গা খুঁজে থু থু ফেলতে গিয়ে দেখলাম কালো কালো কফের মত কি যেন বেরুচ্ছিল। দৌড়ে গিয়ে একটা চেইন শপের ভেতর আশ্রয় নিয়ে ছেলেকে কল করলাম। সে গাড়ি নিয়ে এসে না যাওয়া পর্যন্ত আমি যে কি কষ্ট আর যন্ত্রণা পাচ্ছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের দেশে অন্তত এই বুশ ফায়ার নাই। আর একটা বিষয় নাই সেটা হলো হিট ওয়েভের তীব্রতা। যা এখানে মাঝে মাঝে আঘাত আনে।

দেশের কথায় আসি: এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে তীব্র গরম থেকে দূরে থাকতে হবে, মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে। শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ করতে প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। তবে হেপাটাইটিস এ, , ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতী পানিবাহী রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে দিনে একাধিকবার গোসল করতে হবে।

গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সম্ভব হলে গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, গরম আবহাওয়ায় ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, তীব্র মাথাব্যথা, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়া, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

আর একটি খবরে দেখলাম: তীব্র গরমে জলাজঙ্গল ছেড়ে সাপ ফাঁকা ঘরবাড়ি ও বাসগৃহ সংলগ্ন ছায়াযুক্ত পরিবেশে চলে আসছে জানিয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এক অনুষ্ঠানে। মঙ্গলবার বিকালে স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশের (এসআরটিবিডি) সহযোগিতায় ঢাকার দারুস সালাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে সচেতনামূলক এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সাপ উদ্ধার ও অবমুক্ত করার কাজের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, বেশকিছু প্রজাতির সাপের প্রজনন মৌসুম নিকটবর্তী হওয়ায় এবং গরমে আরামদায়ক পরিবেশের সন্ধানে সাপ জলাজঙ্গল ছেড়ে ফাঁকা ঘরবাড়ি ও বাসগৃহ সংলগ্ন ছায়াযুক্ত পরিবেশে চলে আসছে। এতে মানুষের সঙ্গে সাপের সংঘাত ও সাপেকাটার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষজ্ঞরা সাপে কাটলে ওঝার কাছে না নিয়ে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে নেয়ার সুপরামর্শ দিয়েছেন।

এতসব ঘটনা আর সতর্ক বাণীর পর ও মানুষ যদি কথা না শোনে তবে তো কিছু করার নাই। সাথে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে হতদরিদ্র মানুষ বা শ্রমজীবী মানুষের পথ নাই। তাদের আয় রোজগার করেই জীবন চালাতে হয়। এবং তা দৈনন্দিন। রিকশা ওয়ালা শ্রমিক নির্মাণ কর্মী বা এমন হাজারো পেশাজীবীর গরমেও কাজ করতে হয় উন্মুক্ত জায়গায়। তাদের জন্য সরকার বা প্রশাসন থেকে আলাদা আলাদা ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সিটি কর্পোরেশানের মেয়রেরা কি শুধু এসি রুমে বসে থাকার জন্য? তাদের দায় দায়িত্ব নিজ নিজ এলাকার নাগরিকদের সুবিধা প্রদান। এসব দেশে গরমের সময় পুলিশ সতর্ক থাকে। মানুষ জন এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। ফায়ার ব্রিগেড আর জরুরি দপ্তরগুলো থাকে সদা সতর্ক। হয়তো দেশেও আছে। কিন্তু তা জানান দিয়ে করা হলে মানুষ ভরসা পায়। তারা দেখুক যে এমন সব সার্ভিস তাদের দোরগোড়ায়।

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় না বলে পারছি না। রঙ্গভরা বঙ্গদেশে মানুষ পারে ও। আমাদের দেশের রাজধানীতে একজন চিফ হিট অফিসার আছে। এমন পদবী আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নাই। সে কথা থাক। বুশরা আফরিন নামের এই হিট অফিসার পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেছেন, সবাই যদি সাথে ছোট ছোট ফ্যান রাখতে পারেন তবে গরমের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। ব্যস। শুরু হয়ে গেলো গালাগাল আর ট্রল। এই ট্রল বিষয়টাই আমার কাছে জঘন্য। যাই হোক বুশরা ফ্যান বলতে কি সত্যি ইলেকট্রিক ফ্যানের কথা বলেছেন? ফ্যানের বাংলা তো পাখা। আপনি কাগজ দিয়ে পাখা বানিয়ে সাথে নিতে পারেন না? তালপাতার পাখা কি দেশে নাই হয়ে গেছে? অতিগরমে আমাদের সহায় ছিল এমন পাখা। যে আমলে কারেন্ট ছিল না বিদ্যুৎ ছিল না সে আমলে মানুষ গরম মোকাবেলা করে নি? এমন পাখা মাটির কলসীর জল আর হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে জানে বাঁচানো মানুষ আমরা। সে আমলে বুশরাকে কেউ গালি দিতো না। বরং বলতো মেয়েটি অন্তত আমাদের পাখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মূল কথা হলো কোন বিষয়কেই সিরিয়াসলি না নিয়ে গালমন্দ করার এক উগ্র প্রবণতা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। আমি বলব এই বুশরাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তাকে আমি চিনি না জানিও না। কিন্তু একটা মেয়ে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করা পরামর্শ দেয়া অপরাধ? আপনি চিকিৎসকের কাছে যান তিনি ও এক ই কথা বলবেন। বলবেন পাখা ব্যবহার করেন। তখন কি আপনি ট্রল করেন?

সে যাই হোক মাথা ঠাণ্ডা রাখা ও কিন্তু গরম কমাতে সাহায্য করে। নয়তো মগজ মাথার হিট স্ট্রোক থামানো যাবে না। গরীব দুঃখি ও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকারের উচিৎ গরমে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা। বলছিলাম দুনিয়ার বহুদেশে এখন গরমকাল এমন তীব্র হয়। অস্বস্তি আর কষ্টে জীবনহানির ঘটনাও ঘটে। বাংলাদেশের এই প্রচন্ড গরমে মানুষ ভালো থাকুক এটাই কামনা।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধইরাকের জনপ্রিয় টিকটকারকে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা