দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ঘুরছিলাম আমরা। শান্তিনিকেতনে। চারদিকে সবুজের সমারোহ, রকমারি গাছগাছালি। ফলের গাছ, ফুলের গাছ। অন্যরকমের এক শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ! পথের ধুলোবালিতে যেন মায়া ছড়ানো। রকমারি গাছের ছায়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো রাস্তায়। নানা ধরনের পাখির কলকাকলি গাছে গাছে। বেশ রোমান্টিক একটি পরিবেশ চারদিকে। উচ্ছ্বসিত মনে পথ চলছিলাম আমরা।
কোনো এক গ্রামে কী এসে পড়েছি! সাজানো গোছানো গ্রাম। ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা গ্রাম। চারদিকে এত এত মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে ক্ষণে ক্ষণে মন ভরে যাচ্ছিল। আরো অনেকেই ঘুরছেন, আরো অনেকেই এসেছেন। তাবৎ বিশ্বের বহু পর্যটকই এখানে বেড়াতে আসেন, আসেন রবি ঠাকুরের স্মৃতি হাতড়াতে। একটি বেশ বড়সড় গ্রুপের দেখা পেলাম। আমাদের কিছুটা সামনে তারা। বড় গ্রুপ, পশ্চিমা। তবে কোন দেশের তা বুঝতে পারছিলাম না। বড় গ্রুপটির সাথে একজন গাইড আছেন। যিনি বেশ চিৎকার করে ইংরেজিতে বিভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমাদের রবি ঠাকুর তাদের কাছে টেগোর। বার বার টেগোর শব্দটি বলছিলেন গাইড। বুঝাচ্ছিলেন রবি ঠাকুরের নানা কিছু। আমি নিজেকে এই কারনেই ভাগ্যবান মনে করছিলাম যে, রবি ঠাকুরের মতো উঁচু মাপের একজন মানুষ আমারই মায়ের ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। তিনি আমাদের কথা বলেছেন, আমাদের মনের সবগুলো কথা কী অবলীলায় তিনি বলে গেছেন। অকাতরে তিনিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের। এত বেশি কিছু দিয়েছেন যে, জীবনব্যাপী চর্চা করলেও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের শেষ হবে না। নোবেল অনেকেই পান, প্রতি বছরই পান। পৃথিবীতে বহু নোবেল বিজয়ী রয়েছেন, এঁদের সবারই প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। কিন্তু একটি কথা আমি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি যে, নোবেল পেলেই যে কেউ রবি ঠাকু্‌র হয়ে ওঠেন না। শুধু মাথা দিয়ে রবি ঠাকুর হওয়া যায় না, রবি ঠাকুর হতে সাধনা লাগে, সাথে ভাগ্যও।
পশ্চিমা যে পর্যটকেরা টেগোর নিয়ে নানা কাহিনী শুনছেন তারা হয়তো অর্ধেকই বুঝছেন না। তবে বেশ মাথা নেড়ে নেড়ে শুনছেন, আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। আমি নিজেকে এজন্যও ভাগ্যবান মনে করছিলাম যে, রবি ঠাকুরের শত শত কবিতা, অসংখ্য গল্প উপন্যাস নাটক আমরা পড়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি। শত শত গান শুনেছি, শোনার সুযোগ পেয়েছি। পশ্চিমা এসব পর্যটক ইচ্ছে করলেও রবি ঠাকুরের বহু কিছু পড়তে পারবেন না, শুনতেও না। রবি ঠাকুরকে উপলব্দি করার জন্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনার জন্য উনার লেখা এবং কথামালা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
হাঁটছিলাম আমরা। ধুলোয় মোড়ানো পথ। পিচঢালা হলেও কোথাও কোথাও রঙ চটে গেছে, লালসে আভা বেরিয়ে এসেছে রাস্তার বুক ছিঁড়ে। কোথাও কোথাও পথের ধারে সাতরাজ্যের গাছগাছালি। আমরাও একজন গাইড নিয়েছি। দু’জনের জন্য একজন গাইড। এতে করে আমাদের গাইড গল্প করার মতো করে কথা বলছিলেন। আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের নানা কাহিনী শুনাচ্ছিলেন। আমাদের গাইডের নাম বিশ্বজিৎ। তিনি শান্তিনিকেতনেরই ছাত্র, চারুকলায় পড়েন। অবসরে গাইড হিসেবে কাজ করেন। কোন দরদাম করলেন না, খুশী হয়ে যা দিই তাতেই নাকি হবে। বিশ্বজিৎ বেশ প্রাণবন্ত একজন মানুষ। বললেন, শান্তিনিকেতন আপনাদের দেখাবো, চেনাবো এটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। চলুন, শুরু করি।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রকে গাইড হিসেবে পাওয়াটাও আমার ভাগ্য বলে মনে হলো। এতে আমাদের এত বেশি সুবিধা হলো যে অন্য কোন গাইড নিলে তা হয়তো হতো না। প্রথমত তিনি শান্তিনিকেতনের সবই চিনেন, জানেন। দ্বিতীয়ত বাংলাভাষী গাইডের প্রতিটি শব্দই আমরা বুঝতে পারছিলাম। এতে কোন কিছু মিস হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কোন কিছু না বুঝলে বারবার জিজ্ঞেস করতেও অসুবিধা হচ্ছিল না।
আমাদের গাইড শুরু করলেন শান্তিনিকেতন শব্দটি দিয়ে। বললেন, নিশ্চয় শব্দটির অর্থ আপনারা জানেন, এটির অর্থ হচ্ছে শান্তির আবাসভূমি। একসময় শান্তিনিকেতন ব্যক্তিগত শান্তির জায়গা থাকলেও আজ লাখো মানুষ এখানে শান্তি খুঁজতে আসেন। যেমন এসেছেন আপনারা। থামলেন আমাদের গাইড, হাসলেনও। আমরা মাথা নাড়লাম।
তিনি আবার শুরু করলেন। বললেন, শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে অবস্থিত। এটি এখন একটি আশ্রম এবং বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ের লেখাপড়াও হয় এখানে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সেরা একটি বিদ্যাকেন্দ্র বলেও তিনি মন্তব্য করলেন। শান্তিনিকেতনের গোড়াপত্তন হয় ১৮৬৩ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রহ্মধর্মের চর্চা শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে অনেক কিছুই করেছিলেন। আশ্রমের পাশাপাশি ধর্মচিন্তা ধ্যানের নানা আয়োজন ছিল। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে জগতজোড়া খ্যাতি লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রিয় জায়গা এই শান্তিনিকেতন। কবি জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময়ই এখানে কাটিয়েছেন। তাঁর গান, গল্প, কবিতা, নাটকসহ সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই আশ্রম এবং শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ বড় বেশি উজ্জ্বলতর ছিল। শান্তিনিকেতনে কবিগুরু নিজের এবং আশ্রমে বসবাসকারী অন্যান্যদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভবন নির্মাণ করেন। পরবর্তীতেও বিভিন্ন ভবন তৈরি হয়েছে। শান্তিনিকেতনের কলেজ অব সায়েন্সের জন্য শিক্ষাভবন, কলেজ অব হিউম্যানিটিজের জন্য বিদ্যাভবন, কলেজ অব ফাইন আর্টসের জন্য কলাভবন, কলেজ অব মিউজিকের জন্য সংগীতভবন, টিচার্স ট্রেনিংয়ের জন্য বিনয়ভবন, কৃষিবিদ্যার জন্য রয়েছে পল্লীশিক্ষাভবন, আর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের জন্য রয়েছে শিক্ষাচর্চা ভবন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার শুরুতেই এখানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে আশ্রমটিকে এখনো সকলেই বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন বলেও গাইড জানালেন। তিনি আমাদেরকে উত্তরায়ণ দেখালেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবন কেটেছে। বেশ কয়েকটি ভবন এখানে রয়েছে। সবগুলো ভবনই পুরানো। তবে কী মোহনীয় ঐতিহ্যমোড়া! আমি ভবনগুলোর দিকে অপার বিস্ময়ে তাকাচ্ছিলাম। কবি সেকালে একটি অস্টিন গাড়ি ব্যবহার করতেন। বহু বছরের পুরানো গাড়িটিও গাইড আমাদের দেখালেন। দেখালেন রবীন্দ্র মিউজিয়াম। যেখানে কবির লেখার মূল পান্ডুলিপি, কবির আঁকা ছবি, কবির নিজের ছবি, চিঠিপত্রসহ নানা কিছু রয়েছে। রয়েছে নোবেল পুরস্কারের মেডেলও। তবে এটি আসল নাকি রেপ্লিকা তা বুঝতে পারলাম না। আমরা একে একে কবির স্মৃতিধন্য ‘উদয়ন’, ‘কোনার্ক’, ‘শ্যামলী’, ‘পুনশ্চ’ ও ‘উদীচী’ গৃহ প্রভৃতি দেখলাম। দেখলাম কবির নিজের হাতে লাগানো মালতীলতা। এই লতা কবি লাগিয়েছিলেন? বিশ্বাস করতেও কেমন যেন গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিল!
গাইড আমাদেরকে নিয়ে সামনে হাঁটছিলেন। কথায় কথায় কত কথা যে তিনি বলছিলেন! কখনো তিনি নিজেও বেশ উচ্ছ্বসিত হচ্ছিলেন। শান্তিনিকেতন বাড়ির সামনে ভারতের বিশ্বখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ এর একটি শিল্পকীর্তি নান্দনিকতা ছড়াচ্ছে। গাইড বললেন, এই মূর্তিটির নাম ‘অনির্বাণ শিখা’। মূর্তিটিতে একটি নারী তার শিশু সন্তানকে কোলে ধরে রেখেছেন। কিন্তু গাইড আমাদের জানালেন যে, এই মূর্তির নারী হচ্ছে জননীর প্রতীক। তিনি এই শান্তিনিকেতনকে তার শিশুর আদলে কল্পনা করেছেন। তিনি ঈশ্বরের নিকট তাঁর শিশুসন্তানের মঙ্গল কামনা করেছেন। অনির্বাণ শিখা বেশ শৈল্পিক একটি মূর্তি। মূর্তিটি সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করে। সকাল ও বিকাল রোদের ছায়ার উপর মূর্তির নান্দনিকতা ফুটে ওঠে। রাতে আলো জ্বলে উঠলে এটির নান্দনিকতায় নাকি ভিন্নমাত্রা যোগ হয়।
গাইড আমাদেরকে ছাতিমতলা দেখাতে নিয়ে গেলেন। একটি ছাতিমগাছের নিচে বেদি। এটি নাকি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনবেদি। শ্বেতপাথরের বেদিতে বসে এখানেই মহর্ষি লাভ করেছিলেন ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’ কথাটি এখানের গেটে লিখে রেখেছেন। সেই বহুবছর ধরে লেখাটি রয়েছে। এখানে প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ এবং আত্মার শান্তি বিরাজ করে। একদিন তা শুধু একজনের থাকলেও আজ যেন তা মানুষের, সকলের। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসডিজি অর্জনে পর্যটন উন্নয়ন সরকারের লক্ষ্য
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর