এসডিজি অর্জনে পর্যটন উন্নয়ন সরকারের লক্ষ্য

মো. আবদুর রহিম | বুধবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সম্পদের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন রোধে ত্বরিৎ উদ্যোগ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সবধরনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণ, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা সীমাকরণের ওপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বরোপ করে যাচ্ছে। এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে দেশীয় শিল্পের বিকাশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ভাবনা ও এসডিজি অর্জনে পর্যটনকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। করোনা মহামারি দুর্যোগে দেশের পর্যটন খাতে ধস নেমে আসে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ধাপে ধাপে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পর্যটন। দেশের পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেশন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যসব কার্যক্রমে ধীরে ধীরে গতি আসছে। বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বহু দেশ পর্যটকদের জন্য ভিসা সেবা চালু করছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোও ভ্রমণের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটনকে গতিশীল করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এটিকে উন্নয়নের একটি খাত হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকার ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে দেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া করোনা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড গৃহীত পরিকল্পনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
এ পরিকল্পনায় ২০১৬-২০২১ সালকে পর্যটনবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছে। পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশে ২০১৫-২০১৮ এই তিন বছরে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য স্থানগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন, ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সরকার দেশকে ৮টি পর্যটন জোনে বিভক্ত করেছে। প্রতিটি স্তরেও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। দেশের কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এগুলোতে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। পর্যটনে সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে কঙবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মহেশখালি সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকায় উন্নয়ন, কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শাপলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, দোহাজারি কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে কক্সবাজার উখিয়া পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণ প্রকল্প সহ ৪টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এর বাইরে দেশের চাঁদপুরে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র। এ প্রকল্পে থাকছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কার, ট্রাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিমপার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোর্ট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোসেন্টার, মার্কেট, জিমনেসিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টি সেন্টার, হলিকর্ণার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, এগিট্যুরিজম, গ্রীণ এনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল সহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা কার্যক্রম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যটন কেন্দ্রটি হবে আকর্ষণীয় ও বিনোদনের নতুন একটি পৃথিবী। ব্লু-রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য বলছে চাঁদপুরের চরের এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা ও ২০ হাজার পর্যটকের রাত যাপনের সুবিধা থাকবে। এতে প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। রেলপথে কক্সবাজার যাতায়াতে নির্মাণাধীন রেললাইনে ব্যয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কক্সবাজারে নতুন ২টি মোটেল নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এ খাতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৮০০ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ বিমান ও নৌ-বাহিনীর উদ্যোগে কক্সবাজারে একটি বড় গেস্ট হাউস নির্মিত হচ্ছে। কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসংখ্য ঐতিহাসিক নির্দশন বিদ্যমান। সেসব বৌদ্ধ নিদর্শন দেখার জন্য শত শত পর্যটক যাচ্ছে। যাতায়াতের সুবিধার্থে ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মিত হয়েছে। এ সড়কটি চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। কঙবাজার শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে বিশাল চর। এখান থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখা যায় এবং সাগর ও নদীর পানির মিলনস্থলের পার্থক্য বোঝা যায়। এই মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সেখানে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। টেকনাফ এলাকায় তৈরি হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম পার্ক। নাফনদের মাঝে একটি চরকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। পর্যটন বান্ধব জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় দেশ ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকায় উন্নয়নে মহেষখালীতেই বিনিয়োগ করছে লাখ কোটি টাকা। মহেশখালীকে পাওয়ার হাব হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপ যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হওয়ার পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রায় এক মাস অবস্থান করেছিলেন। সেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সোনাদিয়া দ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার সরকারি বেসরকারি পার্টনারশিপে দেশের আরো ৭টি প্রকল্প নির্ধারণ করেছে। এরমধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর ও বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ প্রকল্প। খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। সরকারের নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণায় পর্যটন খাতের বিকাশে আরো নতুন মাত্রা সংযোজন হলো। এ খাতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে থাইল্যাণ্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়াম সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল।
জানা যায় এই কোম্পানিটি প্রাথমিক ভাবে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গা জুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ-অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সরকারের নতুন নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। দেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার সরকারের এই শাসন আমলে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যটন নির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠতে যাচ্ছে সাবরাং সমুদ্র তীরে। পরিকল্পিত এ আধুনিক পর্যটন পার্কে বিনিয়োগ আগ্রহী দেশি-বিদেশী বহু উদ্যোক্তা। এরই মধ্যে ১২টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে বেপজার নির্বাহী বোর্ড। কোম্পানী গুলোর প্রস্তাবে আছে তারকা হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে এই পার্কে। বেজা এ পার্কে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে ১ হাজার ৪৭ একর আয়তনের জায়গায় অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এ পার্কের জন্য অনুমোদন পাওয়া ১২টি কোম্পানি ১১৬ একর জায়গায় বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করবে। এ প্রকল্পে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে পর্যটন শিল্পের সাথে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ এভিয়েশন খাতকে আধুনিকতার ছোয়ায় নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। দেশে নতুন নতুন বিমানবন্দর স্থাপন, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি, আভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক রুটে বিমানের ফ্লাইট বৃদ্ধি, বিমানবন্দর আধুনিকায়ন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানোই হচ্ছে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধআসুন মানুষের মতো মানুষ হই
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে