দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাত-সকালের অপরূপ এক মুগ্ধতা চারদিকে। শান্ত, স্নিগ্ধ। অন্যরকমের এক পবিত্রতা যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে পরিবেশ। বাহ, কী নির্মল! মন ভরে যাওয়া এক প্রশান্তি খেলা করছিল আমার বুক জুড়ে। অন্তরজুড়ে সুখানুভূতি। সুখনা লেকের পাড়ে হাঁটছিলাম আমরা। লেকে টলমল করছে পানি। নীলাভ জল। যেন বিশালাকারের একটি সুইমিং পুল। দূর পাহাড়ের ছবি খেলা করছিল লেকের পানিতে। ভাসছে অসংখ্য নৌকা। জলে স্থলে অসংখ্য মানুষ। তারা আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত। গাছে গাছে পাখির কলতান মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। আমি এবং আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক হাঁটছিলাম। এদিক ওদিক। নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য না থাকলেও শুধু দেখার জন্যই ঘুরছিলাম আমরা। এডিটর স্যার অনেক ধরনের ছবি তুললেন। লেক,পাড়,পাখি,মানুষ- নানা কিছুর নানা এ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছিলেন তিনি। কখনো মানুষের। কখনা প্রকৃতির। কখনোবা মানুষ নৌকা প্রকৃতি সবকিছুকেই একই ফ্রেমে বন্দী করছিলেন। একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার হিসেবে স্যারের সুনাম রয়েছে। দুনিয়ার যেখানে যান সেখানেই গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে তিনি ক্লিকে ক্লিকে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। আমারও অনেকগুলো ছবি তুলে দিলেন তিনি। তবে কুয়াশার কিছু উৎপাত দেখা গেল।
সুখনা লেকের কাছেই গলফ কোর্স। সাইনবোর্ড দেখা গেল। একটি এ্যারো মার্ক দিয়ে গলফ কোর্সের পথ দেখানো হয়েছে। গলফ খেলার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। এটি বড় লোকদের খেলা। রাজা বাদশাহদের খেলা। তবে গল্ফ ক্লাবের খাওয়া দাওয়ার দারুণ আয়োজন আমাকে বেশ টানে। সবুজ চাদরে ঢাকা বিশাল গল্ফ কোর্সটাই আমাকে মুগ্ধ করে। আমাদের ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব কিংবা শাহীন গলফ ক্লাবে অনেকবার গিয়েছি। গলফ মাঠে বল না ছুঁড়লেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। হেঁটেছি। এতে করে সাত সকালে এত দূরে এসে গলফ কোর্স দেখার কোন টান আমি অনুভব করলাম না। গল্ফ কোর্সের চেয়ে সুখনা লেকের জলরাশি আমাকে বেশি টানছিল। স্যার গল্ফ মাঠে ছবি তুলতে যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি মাথা নাড়লেন। না, কোন দরকার নেই। হাঁটতে গিয়ে অন্যদিকের ছোট্ট একটি সাইন বোর্ড আমার নজরে পড়লো। চমকে উঠলাম। রক গার্ডেন? এখানেই? এ্যারো মার্ক দেয়া আছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজনকে দাঁড় করিয়ে এ্যারো মার্ক দেখিয়ে কত দূরে জানতে চাইলাম। বেচারা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সামনের দিকে হাত উঠালেন। আঙ্গুল দিয়ে যা দেখালেন তাতে মনে হলো দোকানের ওপাড়টাই রক গার্ডেন। বুঝতে না পেরে আরো একটু খোঁজ নিলাম। জানলাম যে, একেবারে হাত ছোঁয়া দূরত্বেই বিখ্যাত রক গার্ডেন।
এডিটর স্যারকে রক গার্ডেনের কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘চল, দেখে আসি। কাছেই তো মনে হচ্ছে।’ ‘এ্যারো মার্ক’ যেদিকে দেখিয়েছে সেই পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম গার্ডেনের গেটে। একেবারেই কাছে। সুখনা লেকের পাড়েই রক গার্ডেনের অবস্থান। একদিকে মানুষ ব্যায়াম করছেন, হাঁটছেন। ঠিক তার সন্নিকটেই ভুবনজয়ী রক গার্ডেন। এত কাছে এত সুন্দর একটি স্থাপনা! হায় হায়, না দেখেই চলে যাচ্ছিলাম! এমন চমৎকার একটি স্থাপনা না দেখে চলে যাওয়ার কষ্ট অনেকদিনেও ভুলতে পারতাম না। এ্যারো মার্ক প্রদানকারীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম।
রক গার্ডেন সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা নিতে নেটে ঢুঁ মারলাম। ভারত জুড়ে দর্শনীয় স্থানের কোন অভাব নেই। অভাব নেই পর্যটনেরও। কোটি কোটি ডলার আয় করা হয় এই খাত থেকে। কি নেই ভারতের? ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে শুরু করে নানা কিছু। প্রকৃতিও অকৃপণভাবে দিয়েছে ভারতকে। একদিকে ধু ধু মরু তো অন্যদিকে তুষারের খেলা। একদিকে পাহাড় তো অন্যদিকে উত্তাল সাগর। সবুজ প্রকৃতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে প্রাণহীন পাথর। প্রকৃতির এত বেশি বৈচিত্র্যতা এই ভারত জুড়ে রয়েছে যে পৃথিবীর সবকিছুই ভারতে পাওয়া যায়। সব কিছুই। পরিবেশ প্রকৃতি এবং সম্পদে ভারতের বৈচিত্রতা এত বেশি যে তাবত পৃথিবীর মানুষই এখানে ছুটে আসে। ভারতের তাজমহল বা লালকেল্লা, কুতুব মিনার কিংবা আগ্রা ফোর্ড যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, স্বর্ণ মন্দির, হুমায়নস টম্প, গুরুদুয়ারাসহ নানা কিছু। নানা ঐতিহাসিক স্থাপনার পাশাপাশি চন্ডীগড়ের রক গার্ডেনের খ্যাতিও রয়েছে। চন্ডীগড়ের বিখ্যাত কয়েকটি স্থাপনার মধ্যে এই রক গার্ডেন অন্যতম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চন্ডীগড়ের সব অচল জিনিস দিয়ে এই রক গার্ডেন তৈরি। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ব্যবহার করেই গড়ে তোলা হয়েছে রক গার্ডেন। শুকনা লেকের পাড়ের বারো একর জায়গা জুড়ে এক ক্ষ্যাপা মানুষের তৈরি রক গার্ডেন। যিনি দুনিয়ার কোন কিছুই ফেলনা নয় এমন একটি বিশ্বাসকে দাঁড় করাতেই সব ধরনের বর্জ্য ব্যবহার করে ভাস্কর্যসহ নানা কিছু তৈরি করতেন। শুরুতে বিষয়টিকে একটি অবৈধ কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও ক্রমে তা শুধু বৈধতাই নয়, দুনিয়ার পর্যটকদের অন্যরকম এক আকর্ষণীয় স্থানেও পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক কোটি মানুষ এই রক গার্ডেন ভ্রমণ করেছেন। প্রতিদিন হাজার পাঁচেক দর্শনার্থী রক গার্ডেন দেখতে আসেন। হাজার হাজার মানুষের এই হিসেবে আজ আমরা দুজনও অন্তর্ভুক্ত হলাম।
চন্ডীগড়ের নেক চাঁদ নামের একজন সরকারি কর্মচারী শহরের নানা স্থান থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে লেকের পাড়ে বসে বসে নানা ধরনের ভাস্কর্য তৈরি করতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কাজটি শুরু করেন। অবসর সময়ের প্রায় পুরোটাই তিনি লেকের পাড়ে বসে কাজ করতেন। নানা ধরনের দেবদেবীর মূর্তিও বানাতেন। বানাতেন নিজের ইচ্ছেমতো নানা কিছু। নিজের কল্পনার ঘুড়ি উড়িয়ে তার মনে যা আসতো তাই তিনি করতেন। তাই বানাতেন। যত ধরনের বর্জ্য তিনি পেতেন তার সবই এখানে এনে জড়ো করে তা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলতেন নিজের ভালো লাগার ভাস্কর্য। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৫। ডিজিটে তেমন হেরফের না থাকলেও দূরত্ব যেন যোজন যোজন। কত দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী। এই দীর্ঘ সময়ের প্রায় পুরোটাই নেক চাঁদ নিজের ভালোবাসা উজাড় করে গড়ে তোলেন রক গার্ডেন। ক্ষ্যাপা এই মানুষটির নামানুসারে নেক চাঁদ রক গার্ডেন নামেও এটি পরিচিত। নানা ধরনের ভাস্কর্য এবং বাগান মিলে ১২ একর জায়গায় গড়ে তোলা রক গার্ডেন পরবর্তীতে সরকার অধিগ্রহণ করে। এটি বর্তমানে একটি সরকারি সম্পত্তি। একক প্রচেষ্টায় এমন একটি শিল্পাঙ্গন গড়ে তোলায় নেক চাঁদকে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবেও সম্মানিত করা হয়। একজন মাত্র মানুষ কেবলমাত্র ইচ্ছেশক্তিকে পুঁজি করে কি করে এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেন তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই নেক চাঁদ রক গার্ডেন। সত্যিই বড় বিস্ময়! আসলেই বিস্ময়!
বেলা বাড়ছিল। সাথে ক্ষুধাও। নাস্তার জন্য ভিতরে ভিতরে তাড়া অনুভব করছিলাম। এডিটর স্যার বললেন, ‘চলো, ওরা খুঁজবে। নাস্তা করতে হবে।’ আমরা একটি টেঙি নিলাম। আবারো চমৎকার এক গোছানো শহরের রাস্তা ধরে ছুটছিল আমাদের বাহন। নানা পথ পেরিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। রুমে গিয়ে দেখি প্রিয়তমা স্ত্রী তৈরি হয়ে বসে আছে। নাস্তা করতে যায়নি। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। তার অপেক্ষাও যে দীর্ঘ হয়েছিল তা বেশ বুঝতে পারলাম। আহা, বেচারি। ইন্টারকমে আমাদের দলের অন্যান্যদের খবর নিলাম। কনফিডেন্স সিমেন্টের কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বৌদিও নাস্তা করতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানালেন। একই কথা জানালেন লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরীও। আমরাও তৈরি। এডিটর স্যারকেও সবার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আমরা রেস্টুরেন্টের পথ ধরলাম। হোটেল তাজ চন্ডীগড়ের চমৎকার সেই রেস্টুরেন্ট। ব্যুফে আয়োজন। পাঁচতারকা হোটেলের ব্যুফে নাস্তা যে কী পরিমাণ শানদার হতে পারে তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। এই ধরনের ব্যুফে আয়োজনে দুনিয়ার সব খাবারের প্রদর্শনী দেয়া হয়। কোন কোন হোটেলে তো পান্তাভাতও দেয়। যার যেটা পছন্দ সেটা নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো খাওয়া যায়। কত আর খাওয়া যায়! একটি সীমা তো আছে। আমাদের একটি বড়সড় টেবিল দেয়া হলো। আমাদের নাস্তাপর্ব যাতে নির্বিঘ্ন হয় সেজন্য দু’তরুণী দাঁড়িয়ে গেলেন। ব্যুফে আয়োজন হলেও দুই তরুণী আমাদের কিছু কিছু খাবার এনে দিচ্ছিলেন। জুস সার্ভ করে দিলেন। পানিও। ধীরলয়ে নাস্তার সাথে তুমুল এক আড্ডায় আমাদের সকালটি বেশ রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম কলেজ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ