মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম কলেজ

লে. কর্ণেল (অব.) মোঃ আবুল কাশেম | বুধবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। ১৯৬৭ সালে আমি চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম বর্ষ বিজ্ঞানে ভর্তি হই। থাকতাম শেরে বাংলা হোস্টেলে। এইচ এস সি পাস করে ভর্তি হলাম পুনরায় এই কলেজে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ। আমাদের বি.এস-সি টেস্ট পরীক্ষা শুরু হলো। সেদিন পরীক্ষা ছিল কেমিস্ট্রি গ্যালারীতে। পরীক্ষা চললেও আমরা তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম বেশী। দুপুর ১টায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ। জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত। খবরটি বিদ্যুৎ গতিতে পরীক্ষার হলে পৌঁছে গেল। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের গভীর ষড়যন্ত্র। এটি ছিল আমাদের জন্য মহা বিপদসংকেত। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত। আমরা একসাথে সবাই পরীক্ষার খাতা ছুঁড়ে ফেলে কেমিস্ট্রি গ্যালারী থেকে লাফদিয়ে বের হয়ে পড়লাম। স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল কলেজের প্রাঙ্গণ। আজ থেকে নতুন দেশ বাংলাদেশ। সেদিন থেকে আমরা আর ক্লাসে ফিরি নাই। দেশের মেধাবী ছাত্র হয়েও আমরা সেদিন চিন্তা করি নাই নিজের জীবন সম্পর্কে। লেখাপড়া সেদিন আমাদের মুখ্য বিষয় ছিল না। এতদিন আমরা কে কোন দলের রাজনীতি করতাম সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই এক হয়ে গিয়েছিলাম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এই আন্দোলনে এবং সক্রিয় ভূমিকা ছিল আমাদের কলেজের।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। বাঙালিদের আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানীরা চালিয়েছিল নির্বিচারে গণহত্যা। শুরু করেছিল অপারেশন সার্চ লাইট। কিন্তু ৬ই এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর শত্রুমুক্ত ছিল। মুক্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে আমরা ইপিআর এবং আমাদের আর্মীকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করি। ৭ই এপ্রিল কোর্ট বিল্ডিং দখল করে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে। তখন চিন্তা করলাম শহরে থাকা আর নিরাপদ হবে না। আমি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাই। আমার গ্রামের বাড়ী মিরসরাই। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যাই ভারতের হরিনা ক্যাম্পে। এটি ছিল ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার। এখানেই আমাদের প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু। তারপর মুক্তিযুদ্ধ।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসের ১৪-১৬ তারিখ আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল সীতাকুন্ড থানার আনোয়ারা জুট মিলে। কুমিরা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে অবস্থান ছিল পাকিস্তান আর্মীর। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসর্ম্পণ করলে আমরা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করি এবং নিয়াজ স্টেডিয়ামে (বর্তমান এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) অবস্থান নিই। মেজর রফিক ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার। স্টেডিয়ামে থাকা এবং অপারেশন পরিচালনার মত পরিবেশ ছিল না। তখন আমি মেজর রফিককে বললাম, আমি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। চট্টগ্রাম কলেজ প্যারেড গ্রাউন্ডে আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলে আমরা সকল প্রকার সুবিধা পাব। তিনি সেটাই করলেন । সোহরাওয়ার্দ্দী হোস্টেলের দোতলায় হলো আমাদের অফিস। শত্রুমুক্ত আমার দেশ, আমার কলেজ। এখানে এসে আমার যে অনুভূতি তা আমার পক্ষে ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। প্যারেড গ্রাউন্ডে সমবেত হয়েছিল আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধা। এখান থেকেই আমরা অপারেশন পরিচালনা করলাম। যারা পাকিস্তানের আর্মীকে সহযোগিতা করেছে তাদেরকে ধরা হচ্ছিল। আমি মুক্ত বাতাসে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরছি। শেরেবাংলা হোস্টেলে গিয়ে দেখি লিচু গাছ তলায় মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্যে হোস্টেল সুপার ডঃ আকন্দ ছিলেন। আমি গিয়ে সামনে দাঁড়াই। তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। কারণ লম্বা চুল এবং গোঁফ আমার চেহারার বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আমি যখন বললাম, আমি আপনার ছাত্র তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি নতুন জীবন ফিরে পেলেন। আমি কলেজের সকল প্রকার নিরাপত্তার প্রতি নজর রাখছিলাম। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। চট্টগ্রাম কলেজের আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। সেদিন পাকিস্তানের করাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। এটি ছিল আমাদের জন্য একটি বিশাল বিজয়। দিনটিকে উদযাপন করেছিলাম আমরা আকাশে গুলি ছুঁড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস অনেক দুঃখ-কষ্টের পর মুক্ত স্বদেশে নিজের কলেজে এই কয়টি দিন আমি খুব উপভোগ করেছি। ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২ আমরা কলেজ ছেড়ে চলে যাই।
দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ। এই কলেজ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মেধাবী এবং সাধারণত শান্ত প্রকৃতির। ১৯৬৭-৬৮ সালে আমি যখন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম তখন দেখিনি কোন ছাত্রকে ধর্মঘটে অংশ নিতে। কিন্তু ১৯৭১ সালে সেই ছাত্ররাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। দেশপ্রেমই ছিল তাদের মাঝে এই পরিবর্তন এবং মানসিক শক্তির উৎস। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমার প্রত্যাশা- জ্ঞান অর্জনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে দেশপ্রেম।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নীল সন্ধ্যা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে