দুই মেধাবী শিক্ষার্থীর চলে যাওয়া ও কাপ্তাই সড়কে চলাচলের নিরাপত্তা

জি. এম. সাদিকুল ইসলাম | বুধবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

জাপানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়সাধারণভাবে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে যাতায়াতের জন্য তারা কখনো ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করে না। বরং হেঁটেই যায়; সে রূপ ৩০ কিলোমিটার অধিক যাতায়াতের জন্য তারা গণপরিবহন ব্যবহার করে। শুধুমাত্র মধ্যবর্তী দূরত্বের জন্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করা হয়।

গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক দিন ছিল। ক্লাস শেষে মোটর বাইক নিয়ে ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরতে বেরোনো পুর কৌশল বিভাগের তিন শিক্ষার্থীর জীবনে নেমে আসে আকস্মিক ভয়ংকর দুর্যোগ। চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ার একটি স্থানে পিছন থেকে শাহ আমানত পরিবহনের একটি বাস তাদের মোটরবাইকটিকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা। স্থানীয় জনতা অতি দ্রুততার সাথে শান্ত সহাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের দিকে নিয়ে যায় এবং আহত দুজন শিক্ষার্থী তৌফিক হোসেন এবং জাকারিয়া হিমুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের এভার কেয়ার হাসপাতালে যেতে থাকে। ঘটনাটি অবগত হওয়ার সাথে সাথেই চুয়েট প্রশাসন থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা একযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল ও এভার কেয়ার হাসপাতালে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতেই মরদেহ শিক্ষার্থীদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গুরুতর আহত জাকারিয়া হিমু বর্তমানে চট্টগ্রামের এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রকৌশল বিদ্যার একজন অধ্যাপক হিসেবে অনুধাবন করতে পারি, কতটা মেধাবী এবং তার সাথে অভিভাবকদের ও শিক্ষার্থীর নিজের কতটা প্রচেষ্টা থাকলে এ রকম একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষতি শুধু পরিবারের নয় রাষ্ট্রের, সমাজের। সোমবারও তাদের সাথে ক্লাস নেওয়া একজন শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে আমি চূড়ান্ত ভাবে মর্মাহত। এ আগেও বিভিন্ন সময়ে কাপ্তাই রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় চুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত এবং নিহত হয়। এর দায়ভার কার?

বর্তমানে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কটি দেশের ব্যস্ততম সড়কগুলোর অন্যতম। কাপ্তাইয়ে রয়েছে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। এই সড়কের কাছাকাছি স্থানে রাস্তার দুপাশে অবস্থিত চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। রয়েছে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার। এ কারণে এই সড়ক ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনে ধারণ ক্ষমতার থেকে অতিমাত্রায় যানবাহন চলাচল করে। তবে কয়েকটি বিষয়ে আশু নজর দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

. সড়কের আয়তনের তুলনায় অত্যাধিক পরিমাণ যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় এ সড়কটি অতি দ্রুত চার লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। একই সাথে যে সকল স্থানে রাস্তার উপরে বাজার রয়েছে সে বাজারগুলো স্থানান্তর করা। কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো প্রকার যানবাহন থামাতে না দেওয়া।

. এই রাস্তায় যত বেশি পরিমাণ সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলে যা বোধ করি বাংলাদেশের অন্য কোনো রাস্তায় এরকম ঘন ত্ব চলে না। উল্লেখ্য যে, এ সকল সিএনজি অটোরিঙার বেশিরভাগই অবৈধ ও লাইসেন্সবিহীন। সময়ের প্রয়োজনে এবং ধারণক্ষমতা বিবেচনায় সিএনজি চালিত অটোরিঙার সংখ্যা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষ করে সকল অবৈধ সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতে হবে। সাধারণভাবে দেখা যায় এই অটো রিঙা গুলো গতি অনেক কম থাকলেও রাস্তার মাঝখান বরাবর চলাচল করে যার ফলে বাস ট্রাক বা অন্যান্য পরিবহনের ওভারটেকিং করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।

. নিরাপদ গণপরিবাহনের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। তাদের জন্য ভাড়া এবং স্টপেজ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। প্রয়োজনে তিন প্রকার বাস থাকতে পারে। স্বল্প সংখ্যক স্টপেজ এর বাস, মধ্যবর্তী সংখ্যক স্টপেজ এর বাস এবং লোকাল বাস। ফিটনেসবিহীন কোনো বাস রাস্তায় চলতে পারবে না।

শেষ করি আবারও জাপানিদের উদাহরণ দিয়ে। সকাল নয়টা ও বিকাল পাঁচটার সময় পিক আওয়ারে তাদের গণপরিবাহন মেট্রোরেল বা ট্রেনে অত্যাধিক ভিড় থাকে। সে কারণে তারা গাদাগাদি করে ১ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা না রেখেও ট্রেনে উঠে চলাচল করে। দরজা বন্ধ করার আগে স্টেশনের কিছু কর্মচারী যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের ভিতরে যত বেশি পরিমাণ ঢোকানো যায় তার চেষ্টা করে। এত ভিড়ের মধ্যেও নৈতিকতার কারণে কোনো প্রকার অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে না। অফিসের বড় কর্তা এবং কর্মচারী সকলে একই সাথে একই ট্রেনেই যাতায়াত করেন। সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য আমাদের যাতায়াতকারীদের মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে আশার বিষয়, ভালো গণপরিবহন পেলে আমাদের যাতায়াতকারীরাও স্বাচ্ছন্দে তা ব্যবহার করতে চান যার উজ্জ্বল উদাহরণ ঢাকা মেট্রোরেল। উন্নত হোক গণপরিবহন। নিরাপদ হোক সড়ক।

লেখক : অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, চুয়েট

পূর্ববর্তী নিবন্ধহরেক পণ্য, বড় মেলা
পরবর্তী নিবন্ধতদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত