চাকরিচ্যুতির শংকায় ৫০ স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী!

তালিকায় রয়েছে অডিট আপত্তি উঠা ১৪ কর্মকর্তার নামও

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৪ মে, ২০২১ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) ৫০ স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিচ্যুতির শংকা তৈরি হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্যিক অডিট আপত্তি উঠা ১৪ কর্মকর্তার নামও। ইতোমধ্যে ১০৪ অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিচ্যুতি হয়েছে।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুদক হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুদক। ওই ঘটনার পর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। এনিয়ে ওই বছরের ২১ জুলাই দৈনিক আজাদীতে “হাজার কোটি টাকা লোপাট! স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, প্রাথমিক পর্যায়ে দুই কর্মকর্তার বেনামি ব্যাংক হিসাবে ৫৭ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের সত্যতা পেয়েছে দুদক” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এদিকে বিপিসির তদন্ত কমিটি ওই বছরের ২৫ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। আর্থিক অনিয়মের ব্যাপকতা ও এসএওসিএল কর্তৃপক্ষের পূর্ণ সহযোগিতা না পাওয়ায় মাত্র ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নমুনা ভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়েছে। এসএওসিএল কর্তৃক সরবরাহকৃত ব্যাংক বিবরণীর ভিত্তিতে হিসাব পর্যালোচনা করা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহ হতে সমস্ত ব্যাংক বিবরণীর সঠিকতা যাচাই সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই তদন্তেও প্রায় তিনশ কোটি টাকার অনিয়মের সত্যতা পায় কমিটি। এ নিয়ে গত বছরের ৭ জানুয়ারি “স্যাম্পল তদন্তে ৩০০ কোটি টাকার অসঙ্গতি, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি, সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই বিপিসির” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠায় বিপিসি। ইতোমধ্যে গত বছরের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. শাহেদ। বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তবে মারা যাওয়ায় মহাব্যবস্থাপক শাহেদকে মামলায় আসামি করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে আত্মসাৎকৃত সরকারি সম্পদ ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিচ্ছে বিপিসি।
জানা যায়, বিপিসির আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও ৫০ঃ৫০ অনুপাতের অংশীদার এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এওসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি হিসেবে এসএওসিএল পরিচালক হন মাঈন উদ্দীন আহমেদ। পরে তিনি ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজরি কমিটির (ম্যাক) প্রেসিডেন্ট হন। বিপিসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমদ এবং মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ বেপরোয়া হয়ে যান। নিজেদের অনিয়ম ঢাকতে বিপিসিসহ প্রভাবশালীদের সুপারিশে নিয়ম বহির্ভূতভাবে একের পর এক লোক নিয়োগ দেন তারা।
এদিকে মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে প্রথমে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) শহীদুল আলমকে প্রধান নির্বাহী করা হয়। পরবর্তীতে বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন বিপিসি চেয়ারম্যান। এরপর থেকে নানা অনিয়ম ও লোকসানী কার্যক্রম বন্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর ধারাবাহিকতায় গত ৩১ জানুয়ারি ৬৮ জন এবং ৩০ এপ্রিল আরও ৩৬ জন অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। এরপর স্থায়ী ৫০জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। কমিটিতে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ম্যাক প্রেসিডেন্ট মিশু মিনহাজকে আহবায়ক, তদারককারী কর্মকর্তা মোরশেদ হোসাইন আজাদ, বিপিসির প্রতিনিধি উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফেরদৌসী মাসুম হিমেলকে সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র অফিসার কামরুল হুদাকে সদস্য সচিব করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিয়োগকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাইয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ওই কমিটিকে দুই মাসের সময় দেয়া হয়েছে। ওই ৫০ জনের মধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি রয়েছে।
অন্যদিকে গত ১২ এপ্রিল বিপিসি ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু বক্কর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে কোম্পানির ৪০৬তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিরণীতে উল্লেখ করা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৩-১৪ হতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর নিরীক্ষাকালে ওই সময়ে বিভিন্ন পদে পরীক্ষা ছাড়া আবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। অভিযোগ উঠা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- সিনিয়র অফিসার (মেইনটেনেন্স) মো. শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দূর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) মো. ফখরুল ইসলাম, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ ও অপা.) মো. মোকাররম হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক, জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) মো. সামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার ( সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডা ও অপা.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. আশরাফ উদ্দিন।
এরমধ্যে উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ ও অপা.) মো. মোকাররম হোসেন ও উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক তুষার নিজেদের প্রাধিকার না থাকা সত্ত্বেও গাড়ি ব্যবহার করে প্রতি মাসে ৯২ হাজার টাকা করে জ্বালানি খরচ নিয়েছেন। ২৪ মাসে তারা প্রায় ২২ লক্ষ টাকার বেশি জ্বালানি খরচ গ্রহণ করেছেন। ওই ২২ লক্ষ টাকা কোম্পানির অনুকূলে ফেরত দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে তাদের চিঠিও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম মোরশেদ হোসাইন আজাদ। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙ্গিয়ে প্রায় ৯৪ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধণের অভিযোগ উঠে উপ-ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হক তুষারের বিরুদ্ধে।
এছাড়া সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তীর চাকরি স্থায়ীর সময় তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। নিয়ম বহির্ভূতভাবে তাকে কোম্পানিতে স্থায়ী করা হয়। আগে চাকরিচ্যুত হওয়ার কয়েক বছর পরে ম্যানেজার (প্রোডা ও অপা.) মো. ছিদ্দিকুর রহমানকে পুনরায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি অডিট আপত্তিতে উঠে আসে।
অডিট আপত্তির বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন এসএওসিএল’র দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারককারী কর্মকর্তা বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক মোরশেদ হোসাইন আজাদ। এ বিষয়ে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কোম্পানির লোকসান কমাতে ৫০ জন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিপিসির পক্ষ থেকে কমিটি করা হয়েছে। ৫০ জনের তালিকায় অডিট আপত্তি উঠা ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছেন। ইতোমধ্যে কমিটি কাজ শুরু করেছে। তবে কারো প্রতি যাতে অবিচার না হয়, সে বিষয়টিও কমিটি খতিয়ে দেখবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যাংকে লেনদেনের সময় আরও আধা ঘণ্টা বেড়েছে
পরবর্তী নিবন্ধবাবুল আক্তারের চিকিৎসা হবে কারা বিধি অনুযায়ী