চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি : আমাদের ঐতিহ্য

সঞ্চয় কুমার দাশ | মঙ্গলবার , ২৬ জুলাই, ২০২২ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেকটি দেশেরই তার নিজস্ব ঐতিহ্য আর ইতিহাস আছে। প্রজন্মদের যদি আমরা এসব সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়ে যেতে না পারি তবে জাতি হিসেবে একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবো। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাঙালি জাতিসত্তার বিভিন্ন সময়ের আঙ্গিকে উত্থান পতন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, যুদ্ধ বিগ্রহ, ইতিহাস এ জাতিকে করেছে ঋদ্ধ। যদি একটি জাতি তার নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে না পারে তবে জাতি হিসেবে সে ব্যর্থ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদেরও ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন-পালন ও ধারণ করা অবশ্যই দরকার। ‘তাজমহল’ ধর্মীয় আবহে নির্মিত হলেও এর ব্যাপ্তি ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলে এসেছে। এরকম পৃথিবীর ইতিহাস পরিক্রমায় দেশে দেশে, যুগে যুগে বহু স্থাপনা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হতে পারে রামুর বৌদ্ধ কেয়াংগুলো ধর্মীয় স্থাপনা, এগুলো আমাদের চেতনা, ইতিহাস আর কৃষ্টির সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে মিশে গেছে। এইসব স্থাপনাগুলো সময়ের আঙ্গিকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের অজান্তেই আমাদের চেতনার অসামপ্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তায় মিশে গেছে। তাই সময় ও সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এই সৃষ্টিশীল কাজগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। চট্টগ্রাম কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি (ওয়ার সিমেট্রি) শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বিশ্বের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। একটা সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমনওয়েলথভুক্ত দেশের সৈনিকদের সমাধিস্থল হলেও এখন কালের সাক্ষী হয়ে আমাদের চেতনায় মিশে অসামপ্রদায়িক আলো ছড়াচ্ছে। ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রাম চারুকলা ইন্সটিটিউট সংলগ্ন এবং মেহেদীবাগে ১৯, বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে চতুর্দিকে পাহাড় ও ধানক্ষেত পরিবেষ্টিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেক আবাসিক এলাকা এখানে গড়ে উঠেছে। তবে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পরিবেষ্টিত ওয়ার সিমেট্রি মুহূর্তেই দর্শক পর্যটকদের নজর কাড়ে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এটি একটি বিনোদনের স্থান বা পার্ক হিসেবে বিবেচিত। আর জাতি হিসেবে এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। আর এ ব্যর্থতার দায় সম্পূর্ণ আমাদের। কারণ আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যগুলোকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমাদের কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে আমরা মনের গভীরে প্রোথিত করতে পারিনি। জাতি হিসেবে এই ব্যর্থতার দায় অবশ্যই আমাদের নিতে হবে। কারণ আমরা আমাদের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ঐতিহ্যগুলোকে বানিয়ে ফেলেছি পার্ক আর বিনোদনের স্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলাকালীন কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশনের আওতায় এটির নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয়। চট্টগ্রামের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে এই নির্জন স্থানে পঞ্চাশের দশকের প্রথমে এই স্থাপনাটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বৃটিশ সেনাবাহিনী এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এখানে মোট সমাধি- ৭৫৫ টি। সূচনালগ্নে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪০০ টি সমাধি ছিল। বর্তমানে এখানে ৭৩১ টি। যার মধ্যে ১৭ টি অজানা ব্যক্তির, বিদেশী সৈন্যদের ২০ টি (১-ওলন্দাজ, ১৯-জাপানী)এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি স্মারক বিদ্যমান। সমাধির বিবরণ : সৈনিক – ৫২৪, বৈমানিক – ১৯৪, নাবিক -১৩। স্থান অনুসারে : যুক্তরাজ্য -৩৭৮, কানাডা -২৫, অষ্ট্রেলিয়া -৯, নিউজিল্যান্ড -২, মিয়ানমার -২, নেদারল্যান্ডস -১, জাপান -১৯, অভিবক্ত ভারত -২১৪, পূর্ব আফ্রিকা -১১, পশ্চিম আফ্রিকা -৯০, অন্যান্য -৪। এখানে একটি বিশেষ লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে, এই সমাধিতে বৃটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশ ছাড়াও জাপানি সৈন্যদের সমাধি রয়েছে। এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় বৃটিশরা যুদ্ধে নিহত শত্রুর সমাধিকেও সমান শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। যাতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধঅপরাধী আইনকে সম্মান করা হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও প্রয়োজনের তাগিদেই আমাদের সকল ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে হাতে আমাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। তাদেরকে জানাতে হবে এগুলো নিছক কোনো বিনোদনের স্থান বা পার্ক নয়। এগুলো আমাদের চেতনার বাতিঘর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ের শুভ কামনা
পরবর্তী নিবন্ধভাড়া ডাকাতি বন্ধের দাবি