গল্প এগিয়ে থাকে গল্পকারের গুণেই

সাদিয়া সুলতানা | শুক্রবার , ৮ মার্চ, ২০২৪ at ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বই না থাকলে জীবনের পথ চলা বন্ধুর হতো। বন্ধুর মতো বইই আমার সঙ্গে আছে। আজ আছে মোহছেনা ঝর্ণার গল্পগ্রন্থ ‘তখন আমরা ঘুমাইনি।’ নাম গল্পটা বইয়ের শুরুতেই আছে। শুরুতেই বেশ রহস্যঘন প্রশ্ন এলো, ‘তখন নিশ্চয়ই আপনারা ঘুমিয়ে ছিলেন?’ এর সঙ্গে উত্তরও এলো, ‘তখন আমরা ঘুমাইনি।’ গভীর একটা উত্তর। উত্তরের আরও গভীরে না গিয়ে জীবনের অগভীর অথচ নির্মল এক আশার গল্প শোনালেন গল্পকার। জীবনের ডজন ডজন বিপত্তির মাঝেও মনটা ভালো হয়ে গেল গল্পটা পড়ে।

এই বইয়ের ‘টিপু একদিন হঠাৎ টাপ্পাইয়া হয়ে গেল’ দুর্দান্ত একটা গল্প। গল্পটা পাঠ শেষে ঈর্ষার একটা চোরাটান অনুভব করলাম ভেতরে, আরে এভাবে এত নির্লিপ্তভাবে টিপুর টাপ্পাইয়া হওয়ার গল্প লেখা যায়! আমি কেন পারিনি! সত্যি অনেকদিন ভেবে ভেবেও এই থিমে একটাও গল্প লিখতে পারিনি। এই গল্পের ইরফান ভাই, টিপু, ফারজানা সবাই তো আমার আশেপাশেই ছিল, গল্পটা তো আমার চোখে বা হাতে ধরা দেয়নি! মোহছেনা ঝর্ণা ঠিকই ধরে ফেলেছেন গল্পটাকে। গল্পের ভেতরে থাকা ব্ল্যাক বেঙ্গল, এক বাটি দুধ, টিপুর বাবা, টিপ্পাইয়া হওয়ার ওষুধ যেসব অনুরণনের জন্ম দিলো, তা সহজে ভোলার নয়। এই গল্পটাকে আমি বর্তমান সময়ে যেসব গল্প পড়েছি সেসবের ভেতরে এগিয়ে রাখবো।

গল্পপাঠকের কাছে গল্প এগিয়ে থাকে গল্পকারের গুণেই। শত শত শব্দে পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেও হয়তো পাঠকের মনমতো একটা গল্পও লেখা যায় না, আবার ছোট একটা পরিসরে জীবনের ছোটছোট সুখদুঃখ গেঁথে একজন গল্পকার পাঠকের জন্য স্বস্তিকর বা অস্বস্তিকর কোনো গল্প লিখে ফেলতে পারেন। ‘রাতের ছায়ালিপি’ গল্পে টাপুর, টুপুরদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকা মেয়েটা তার জীবনের অস্বস্তিকর গল্পগুলো যখন বলতে শুরু করে তখন পাঠক হিসেবে আমি অস্বস্তি নিয়ে চমকে উঠি আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, মেয়েবেলার এই অস্বস্তিগুলো এমন নিখুঁত ছায়ালিপি করতে পারেন যিনি তাঁর লেখা নিশ্চয়ই ধারাবাহিকভাবে পড়বো।

পুলসিরাত’ গল্পটি একজন রুনু আপা আর তার ‘জারুয়া’ বাচ্চার গল্প। নির্লিপ্তভাবে বলে যাওয়া গল্পটি ভীষণ নির্মমভাবে বলেছেন গল্পকার। রুনু আপাদের জারুয়া বাচ্চাদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয় তা জানা থাকলেও এই গল্পের পুলসিরাত পার হতে হতে জেনেছি জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা থাকে না।

পড়ে থাকে পাখির ছায়া’ গল্পটি পড়তে শুরু করেই টের পেলাম এই গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। পেছনে ফিরে দেখি বইয়ের প্রথম পাঁচটি গল্পই উত্তম পুরুষে লেখা। কেন যেন মনে হলো গল্পকার ‘আমি’তে নিজেকে সমর্পণ করেছেন বলেই পাঠক আমিও শুরুর পাঁচটি গল্পে একাত্ম হতে পেরেছি। বিশেষ করে ‘পড়ে থাকে পাখির ছায়া’ গল্পে নব্বই দশকের দিনগুলোতে ফিরে তাকানোর সুযোগ এলো বলেই হয়তো গল্পটি আরও বেশি আপন হয়ে উঠলো। কিন্তু গল্পের শেষে পাখির জন্য মন ভীষণ খারাপ হলো। একসময় কিশোরীদের আড্ডা জমিয়ে রাখা পাখির মতো মেয়েরা কেন হরেক স্বপ্ন কবর দিয়ে সান্নিধ্যের বাইরে চলে যায়প্রশ্নটাও বিমর্ষ করে রাখলো অনেকক্ষণ।

অমীমাংসিত তালগাছ’ গল্পটা আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজের একটা চেনা চিত্র। যদিও গ্রাম্য সালিশবৈঠকের মাধ্যমে ধর্ষকের বিচার করার প্রবণতা এখন অনেক কমে এসেছে তবু এই সমাজ থেকে এই ধরনের অনেক প্রথাই একেবারে নির্মূল করা যায়নি। এই গল্পের সমাপ্তিটা অসম্পূর্ণ মনে হলেও ধর্ষিতা কুলসুমের মা নুরুন্নেসার আপোষহীন মনোভাব আশা জাগিয়েছে। টান টান মেরুদণ্ডের নুরুন্নেসার কথা পড়তে পড়তে মনে পড়েছে, লুনা রাহনুমা অনূদিত সোমালিয়ার কথাসাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহর উপন্যাস ‘বাঁকা পাঁজরের মেয়ে’ বইয়ে একটি প্রচলিত সোমালি প্রবাদ পড়েছিলাম, ‘ঈশ্বর নারীকে সৃষ্টি করেছেন একটি বাঁকা পাঁজর থেকে; আর কেউ যখন এটাকে সোজা করার চেষ্টা করে, সে এটাকে ভেঙে ফেলে।’ ‘অমীমাংসিত তালগাছ’ গল্পের নুরুন্নেসা যেন এমন নারীদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

পৃথিবী ছাড়িয়ে’ গল্পটা পড়তে পড়তে অপাপবিদ্ধ সন্তান আর তার মায়ের সঙ্গে অন্য এক পৃথিবীতে চলে গিয়েছিলাম। যখন ভাবছি এ কোন পৃথিবী, এই পৃথিবী তো চিনি না, এই পৃথিবী কেন এত নির্মল, সত্যিই কি মহামারি আমাদের পৃথিবীকে এমন করে বদলে দিতে পারেঠিক তখনই একটা ধাক্কা খেলাম। চোখের মধ্যে চোখের জলে বাস করতে থাকা সন্তানটি গল্পের মায়ের মতো আমার হৃদপিণ্ডটাও দুমড়েমুচড়ে দিলো। বুঝলাম, এ আসলে গল্প নয়, এ মা আর সন্তানের মাঝখানের অদৃশ্য সাঁকোকে নতুন করে নির্মাণ করা যেখানে ‘মহাবিশ্বের সকল’ জাদু এসে মিললেও কী করে যেন চারদিক বিবর্ণ হয়ে থাকে।

গল্পকার মোহছেনা ঝর্ণার ‘তখন আমরা ঘুমাইনি’ গল্পগ্রন্থের প্রত্যেকটি গল্পের শেষে রচনাকাল উল্লেখ করা আছে। খেয়াল করে দেখলাম, উত্তম পুরুষের বাইরে বের হয়ে লেখা ‘ঝিঁ ঝিঁ দম্পতি’, ‘বাবার মুখ’ গল্প দুটি অপেক্ষাকৃত আগে লেখা। বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কাছাকাছি সময়ে লেখা এবং সাম্প্রতিককালে লেখা গল্পগুলোতে গল্পকার অনেক বেশি সহজ ও পরিণত। তাই বোঝাই যাচ্ছে গল্পকার মোহছেনা ঝর্ণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখাকে আরও শাণিত করছেন, সেইসঙ্গে তিনি যে বাংলা সাহিত্যের বিশাল জগতকে সমৃদ্ধ করবেন সেই সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধলেখক ও নগর