একজন অভিযাত্রী আর একজন রাজ্যজয়ী পরস্পর অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন, মার্কো পোলো ভ্রমণ শেষে অলক্ষ্য নগরীগুলোর বর্ণনা করছেন কুবলাই খানের কাছে… আর, পাঠকের সামনে জগতের আশ্চর্য সব দরজা খুলে দিচ্ছেন ইতালো কালভিনো, ‘ইনভিজিবল সিটিজ’ উপন্যাসের জাদু–বাস্তবতার সেই ঘোরলাগা জগৎ। মার্কো পোলো তাঁর উপলব্ধির কথা তো আসলে আমাদেরকেই বলছেন– ‘এ পৃথিবী আশাবাদের জায়গা নয়, এ পৃথিবী নিয়ত ক্ষয়িষ্ণু…’
ইতালির প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইতালো কালভিনো–র জন্ম ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর কিউবার হাভানায়। শৈশব কেটেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। বাবা ছিলেন কৃষিবিদ, মা উদ্ভিদবিজ্ঞানী। মেক্সিকো বিপ্লবের কিছুদিন পর তারা ইতালির সান রেমোয় চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন প্রখ্যাত শহর তুরিনে। ছোটোগল্প প্রধান বিচরণক্ষেত্র হলেও লিখেছেন বেশ ক’টি আলোচিত উপন্যাস। ‘আওয়ার অ্যানসেস্টর’ ট্রিলজি এবং গল্প সংকলন ‘কসমিকমিক্স’–এর জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী আলোচিত লেখক। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘ইনভিজিবল সিটিজ’’ উপন্যাসটিকে। ‘দ্য রিটেন অ্যান্ড আনরিটেন ওয়ার্ড’, ‘সিক্স মেমোস ফর দ্য নেক্সট মিলেনিয়াম’, ‘লিটারেচার মেশিন’, ‘হোয়াই রিড দ্য ক্ল্যাসিক্স’, ‘সাইন্স অ্যান্ড মেটাফর’, ‘এসেজ অন ক্ল্যাসিক লিটারেচার’ ইত্যাদি প্রবন্ধ সংকলনগুলো বোদ্ধা ও সমালোচকদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ। ১৯৮৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু, ইতালির রোমে।
১
তুরিনে আমি দৈবক্রমে গিয়েছিলাম। আমার জীবন পুরোদমে শুরুই হয়েছিল যুদ্ধের পর, তার আগে আমি সান রেমোয় ছিলাম, জায়গাটা ছিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীদের থেকে বহুদূরে। সান রেমো থেকে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করলাম, তখন সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে তুরিন আর মিলান–কে নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হল। দুজন লেখকের কথা ভাবলাম, যাদের একজন চেসারে পাভিসি, আমার এক দশকের অগ্রজ, যিনি আমার লেখার প্রথম পাঠক; তিনি থাকেন তুরিনে; এবং এলিও ভিত্তরিনে, আর–এক জ্যেষ্ঠ লেখক, থাকেন মিলানে। এসব কারণে এই দুটি নগরী নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। যদি মিলানকে বেছে নিতাম! প্রাণোচ্ছল, সাহিত্যের নগরী মিলান, যার সবকিছুই অন্যরকম। অন্যদিকে তুরিন ছিল গভীর আর একাগ্রচিত্ত, যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আড়ম্বরহীন স্থান! সুতরাং তুরিনকে বেছে নেওয়ার মানে ছিল তার সাহিত্য ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি এক ধরনের নৈকট্য অনুভব। তুরিন দিনে দিনে হয়ে উঠছিল ফ্যাসিবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নগরী। আরও কিছু কারণ অবশ্য ছিল। তুরিন গুরুত্বপূর্ণ প্রোটেস্টান্ট শহর আর আমার জন্মও চরম নীতিবান পরিবারে। আমার ডাকনাম কালভিন, ইতালি উচ্চারণে যা হয় কালভিনো। সান রেমোয়, ছ–বছর বয়স থেকেই প্রোটেস্টান্ট এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষকরা আমার মাথায় শুধু বাইবেল ঢোকাতেন, আর তখন থেকেই আমার ভিতর দ্বন্দ্ব জন্ম নিচ্ছিল। ভাবনাচিন্তাহীন, বিশৃঙ্খল ইতালিতে আমি চরম বিপন্নতা অনুভব করলাম, এই বিপন্নতাই একসময় আমাকে ইতালির উল্লেখযোগ্য কয়েকজন চিন্তকের মতো চিহ্নিত করে ফেলল, যারা বিশ্বাস করতেন সমস্ত বিশৃঙ্খলার পেছনে আছে প্রোটেস্টান্টদের সংস্কারহীনতা। অন্যদিকে, পিউরিটানদের যেরকম মনমেজাজ থাকে, আমার আদৌ সেরকম কিছু ছিল না। আমার কুলনাম কালভিনো কিন্তু পারিবারিক নাম, অবশ্যই ‘ইতালো’।
২
কখনও কেউ যদি এ–কথাটি স্বীকার করেন যে একজন লেখকের কাজ পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে যে–পরিবেশে বসে তিনি লিখছেন, তার ভেতরে লেখা তৈরি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দৃশ্যাবলী এবং সেই দৃশ্যাবলীর উপাদানগুলো দিয়ে তাহলে তাকে এ–কথাটিও স্বীকার করতে হবে যে, লেখক হওয়ার জন্য তুরিনই হলো স্থান হিসেবে আদর্শ।
আমি বুঝতে পারি না একজন লেখক সেই শহরগুলোর একটিতে বসে কীভাবে লিখতে পারেন যেখানে বর্তমানের চিত্রগুলো এতোটাই অপ্রতিরোধ্য, এতোটাই শক্তিশালী যে তারা লেখককে কোনও স্থান বা নীরবতা ছেড়ে দেয় না।
এখানে, এই তুরিনেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত লেখাটি লিখতে পারবেন, কারণ এখানে অতীত এবং ভবিষ্যৎ বর্তমানের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি; তুরিন– অতীত–ইতিহাসের গতি ও শক্তি এবং যা কিছু ঘটতে পারে অনাগতের (ভবিষ্যতের) সেই পূর্বাভাস বর্তমানের বিচ্ছিন্ন ও প্রথাগত চিত্রকল্পগুলোকে গভীরভাবে অনুভবযোগ্য করে এবং নতুন বোধের উপলব্ধি দেয়; তৈরি হয় সমগ্রের সঙ্গে সংযোগ!
তুরিন এমন এক নগর, যে–নগর লেখককে দেয় প্রাণশক্তি, লেখায় দেয় বহুমাত্রিক স্বর, সন্ধান দেয় নতুন লিখন–শৈলীর, নতুন যুক্তির; তারপর– লেখকের সামনে উন্মাদনার এমন এক জগত খুলে দেয় সৃষ্টি যেখানে পূর্ণতার আলোয় খেলা করে বর্ণিল শিহরণে!