জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৮ মার্চ, ২০২৪ at ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তাআলাকে ভয় করুন! ইসলামকে আল্লাহর একমাত্র মনোনীত পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করুন। ব্যক্তি পরিবার সমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী জীবন বিধান অনুসরণ করুন। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে চলুন।

শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা ইসলামের দাবী: মানব জাতির শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা। ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ন্যায় নীতি ইনসাফ সততা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা ও প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামের প্রতি অনুগত নিবেদিত মু’মিন মুসলিম বান্দা সমাজে অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, শঠতা, কপটতা, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মিথ্যাচার প্রতারণা ও অসামাজিক অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে পারেনা, ইসলাম মু’মিনের চারিত্রিক উন্নত জীবন গঠনের লক্ষ্যে মু’মিনদের ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ ও নৈতিকতা পরিশুদ্ধ করার আবেদন উপস্থাপন করেছে।

সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব: ইসলামে শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সততা ও আমানতদারিতার উত্তম গুণাবলী অর্জন ও ধারণকে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের বিচার কার্য পরিচালনা কর তখন মীমাংসা করো ইনসাফ ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দেন, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (আল কুরআন, সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৮)

শান্তি শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য ন্যায়নীতির উপর অটল অবিচল থাকা অপরিহার্য: পরিবার ও সমাজে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ থেকে দূর্নীতি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য বিদায় নেবে। সর্বস্তরের মানুষ যদি তার অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা লাভ করে তখন কোথাও আর অশান্তি থাকবেনা। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা হলে অপরাধ সংঘটনের মাত্রা ক্রমশ লোপ পাবে। আইনের প্রতি শুদ্ধাশীল থাকা, বিচারকার্য নিজের স্বার্থের বিপক্ষে গেলেও সুবিচার মেনে নেওয়ার চেতনাবোধ জাগ্রতা করা, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে অনুপ্রানিত হওয়া, আল কুরআনের উত্তম নির্দেশনা। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “মুমিন গণ! আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে তোমরা ন্যায় বিচারে অটল থেকো। যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা মাতা পিতার কিংবা তোমাদের স্বজনদের বিরুদ্ধেও যায়। সে যদি ধনী হয় বা গরীব হয় তাহলে তাদের উভয়ের জন্য আল্লাহ তা’আলাই উত্তম অভিভাবক। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ন্যায় বিচার থেকে বিরত থেকো না। আর তোমরা যদি ঘুরিয়ে কথা বলো বা সত্য গোপন করো তাহলে মনে রেখো তোমরা যা করছো আল্লাহ তা’আলা তার সব খবরই রাখেন। (সূরা: নিসা, আয়াত: ১৩৫)

ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে হবে: হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে সর্ব শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী রাসূলগন, সমাজে ন্যায়নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাগুতী অপশক্তির নানাবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, সকল প্রকার প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছেন। অন্যায়ের সাথে বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি, কঠিন পরিস্থিতিতে নাজুক ক্রান্তিকালেও অন্যায়ের প্রতিরোধ করেছেন। শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার জন্য এ গুরুদায়িত্ব পালন করলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করা যায়। সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ এ গুরুদায়িত্ব নবীজির পদাঙ্ক অনুযায়ী উম্মতের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি তোমাদেরকে মানবজাতির কল্যানের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দিবে অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে।” (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

অন্যায়ের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে: সমাজে অনেক ধার্মিক ব্যক্তি আছেন যারা ব্যক্তিগত ভাবে ভালো কাজ করেন কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরবতা পালন করেন, তারা পরিপূর্ণ মু’মিন হতে পারেনি, অন্যায় অনৈতিক অসামাজিক অনৈসলামিক কাজ দেখার পরও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা বোবা শয়তানের পরিচায়ক। অন্যায় কাজ দেখার পরও প্রতিবাদ না করা অন্যায় কাজ সমর্থন করার নামান্তর। হাদীস শরীফে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখে তখন সে যেন তা হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) প্রতিরোধ করে। আর যদি সে এ ক্ষমতা না রাখে তবে সে যেন মুখের (কথার) দ্বারা তা প্রতিরোধ করে যদি সে এ ক্ষমতাটুকুও না রাখে তবে যেন অন্তরের দ্বারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে (এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে) আর এটা দূর্বলতম ঈমানের পরিচায়ক) (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, খন্ড: , পৃ: ২০)

দুর্বল ও অক্ষমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করতে হবে: সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবল, দূর্বল, অসহায়, বঞ্চিত সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ও সক্রীয় ভূমিকা পালন করা ঈমানের দাবী। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, তাবিঈ হযরত তাউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ সেই জাতিকে পবিত্র করেন না, যাদের মধ্যে দূর্বল ও অক্ষমদের অধিকার আদায় করা হয় না। (সুনানে বায়হাকী)

ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় সৃষ্টির প্রতি দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন করা: মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এ নীতি বাক্যে বাস্তবায়ন ইসলামেরই শিক্ষা। মানুষের প্রতি দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন। মানবতার কল্যাণে নিজকে উৎসর্গ করা, জনসেবা সমাজসেবা ও মানবসেবায় রয়েছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। অসহায় মানুষের দু:খ দুর্দশা অবলোকন করার পরও মানবতার সেবা ও মানুষের কল্যাণে যারা এগিয়ে আসেনা মনুষ্যত্ববোধ তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়নি। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত জরীর ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি করুণা করেনা আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি করুণা করেন না। (বুখারী, খন্ড:, পৃ:১০৯৭)

নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াতে হবে: আজকের পৃথিবীতে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা নির্যাতিত নিপিড়ীত নিষ্পেষিত নিগৃহীত। সর্বত্র তারা লাঞ্চিত বঞ্চিত ও অবহেলিত, জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অসহায় মানুষদের স্বার্থ ও অধিকার আজ চরমভাবে উপেক্ষিত। সুদীর্ঘ সত্তর বৎসর কালধরে ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানরা আজ সার্বিক ভাবে অধিকারহারা। জালিম অত্যাচারী ইসরাঈলীদের বর্বরোচিত ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় ফিলিস্তিন বাসীরা নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত, প্রতিনিয়ত ইসরাঈলী আগ্রাসী জালিম গোষ্টীর নির্যাতনের স্টীম রোলারে প্রতিটি মুসলিম জনপদ বর্তমানে মানবশূন্য জনপদে পরিণত হয়েছে, বিশ্ব বিবেক আজ নিরব নির্বিকার ওআইসি, আরবলীগ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠন সংস্থার ন্যাক্কার জনক ভূমিকা আজ বিবৃতি ও নিন্দা জ্ঞাপনে সীমাবদ্ধ। ফিলিস্তিনে ইসরাঈলী কর্তৃক গণহত্যার মহোৎসব চলছে। বিশ্ব মুসলিম নীরব দর্শকের ভূমিকায় তাকিয়ে আছে। কোথাও জোরালো কোনো পদক্ষেপ ও কার্যকরী কর্মসূচি নেই। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণী “বিশ্ব মুসলিমরা এক অখন্ড ভ্রাতৃসংঘ।” হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত নু’মান ইবন বশীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, পারস্পরিক ভালোবাসা, সৌহার্দ্য অনুগ্রহ এবং মায়া মমতার দৃষ্টিকোন থেকে সমস্ত মুসলমান একটি দেহের সমতুল্য। যদি দেহের কোন অংশ অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গও জাগ্রত কিংবা জ্বরের অবস্থায়ত্ত সমঅংশীদার হয়। বিশ্ব আজ অশান্ত, কোথাও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা আজ সর্বত্র চরমভাবে উপেক্ষিত। পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইনসাফ ভিত্তিক শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরন অপরিহার্য। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্মজীবী নারীর অধিকার : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
পরবর্তী নিবন্ধগল্প এগিয়ে থাকে গল্পকারের গুণেই